ইত্তেহাদ স্পেশাল

স্বপ্ন ছিল ঘর বাঁধবেন,বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না শহীদ সুজন মাহমুদের

image 197108 1746623080
print news

বরুন কুমার দাশ: স্বপ্ন ছিল ঘর বাঁধবেন, নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে নতুন জীবন শুরু করবেন, কিন্তু তার আগেই রক্তাক্ত হলো সেই স্বপ্ন। ৫ আগস্ট ঢাকার রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তরুণ প্রকৌশলী সুজন মাহমুদ। একটি সম্ভাবনাময় জীবনের হঠাৎ ছিন্ন-ভিন্নœ হয়ে যাওয়া যেন এই সময়ের এক নির্মম বাস্তবতা।

স্বৈরাচার পতনের পর গণমানুষের স্বপ্নময় উদ্দীপনায় যখন রাজপথ মুখর, তখনই ক্ষমতাদর্পী স্বৈরশাসকের ঘাতক বুলেট এক নিষ্পাপ প্রাণের স্বাপ্নিক অভিযাত্রার রাশ টেনে ধরে।

ক’দিন পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল যে যুবকের, কথা ছিল ফুলশয্যার মায়াবী আবহে বিভোর হয়ে নতুন স্বপ্ন বোনার, তার ঠিকানা রচিত হলো কবরের নিকষ আঁধারে।

শহীদ সুজনের গল্প শুধু একজন তরুণের ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি প্রজন্মের লড়াই ও বিসর্জনের মন কেমন করা এক বিষাদগাথা।

২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল তরুণ প্রকৌশলী সুজন মাহমুদের (৩৪)। কিন্তু তার আগেই, ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে রাজধানী ঢাকার মিরপুরে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। ফলে বিয়ের পিঁড়িতে আর বসা হয়নি তার। অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে অকালেই ঝরে গেল একটি তাজা প্রাণ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী শহীদ সুজন মাহমুদের বড় বোন রাবেয়া খাতুন সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পৌরসদরের রূপপুর নতুনপাড়া মহল্লার নিজ বাসভবনে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানান। এ সময় সুজনের মা শামছুন্নাহার বেগম এবং মেজ ভাই সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

শহীদ সুজনের বোন রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘কী দোষ ছিল আমার ভাইয়ের? তাকে কেনো নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হলো?’ তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে আমার সঙ্গে কথা হয়। সুজন নিজেই ফোন করেছিল। হয়তো শেষ কথাগুলো বলার জন্যই। ভাবতেও পারিনি, ওর সঙ্গে এটাই হবে শেষ কথা।’

‘আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ? ভাই বলেছিল, গরুর মাংস দিয়ে খেয়েছে। আমি বলেছিলাম, তুমি আজ মিছিলে যেও না। সে বলেছিল, ‘আজ আর কোনো সমস্যা নেই। শেখ হাসিনা তো পালিয়ে গেছে। পুলিশ আর গুলি করবে না।’ কিন্তু বিকেল পাঁচটার দিকে ওর বন্ধুরা ফোন করে জানায়, সুজন আর নেই।’

সুজনের শোকে স্তব্ধ মা শামছুন্নাহার বেগম (৬৫) বলেন, ‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। কী দোষ ছিল আমার ছেলেটার? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে কেন এভাবে তার প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো? আমি আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাই।’

শহীদ সুজন মাহমুদ সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রূপপুরে ১৯৯১ সালের ৩০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রূপপুর নতুনপাড়া মহল্লার মৃত আলহাজ্ব আবদুর রশিদ মাস্টারের ছোট ছেলে।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন সুজন মাহমুদ। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে কিছুদিন চাকরি করার পর নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। থাকতেন মিরপুর-৬ নম্বরে ভাড়া বাসায়। ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে মা, ভাই ও বোনের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন কিছুদিন। কিন্তু মৃত্যুর আগপর্যন্ত মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

মেজ ভাই, স্কুলশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, বিএসসি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সুজন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরে নিজের ব্যবসা শুরু করেন।

৫ আগস্ট বিকেলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি আরও বলেন, রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে তার লাশ শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহনগর ইউনিয়নের রতনকান্দি গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ৬ আগস্ট সকাল ৯টায় বাদলবাড়ি শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ.)-এর মাজার প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে হাবিবুল্লাহ ইয়েমেনি মাজার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ সুজনের বড় ভাই শাহীন উদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিকে খুঁজে বের করে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।’

পরিবারের সদস্যরা জানান, শহীদ সুজন মাহমুদ রাজধানী ঢাকায় ‘ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি বিডি’ নামের নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ইলেকট্রনিক্স পণ্য অনলাইনে বিক্রি করতেন তিনি।

শহীদ সুজন মাহমুদ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নেন। মিছিলটি মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মিরপুর-৬ নম্বরের দিকে যাওয়ার সময় বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে মিরপুর মডেল থানা থেকে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে।

তখন মানুষজন বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি শুরু করে। ঠিক তখনই একটি গুলি সুজন মাহমুদের ঘাড়ে বিদ্ধ হয়। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ সুজনের মা শামছুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। মৃত্যুভয় তাকে আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সুজনের স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। সে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।’

সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে ভাই সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়াও জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঈদের আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন।’

সুজন মাহমুদ হত্যার ঘটনায় ২০ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর সিএমএম কোর্টে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। শহীদ সুজনের মেজ ভাই সুলতান মাহমুদ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.