গণপূর্ত অধিদপ্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম শত কোটি টাকার মালিক


অনলাইন ডেস্ক : ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামের অসীম দৌরাত্ম চলছে। গণপূর্ত উপদেষ্টার নাম ভাংগিয়ে তিনি নিয়োগ ,বদলী,পদায়ন ও বিভিন্ন জোনে বাজেট বরাদ্দ করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ৮ মাসে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার অর্থ, প্রভাব ও প্রতিপত্তি রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। দলীয় রাজনীতি তার কাছে ছিল ধরাশায়ী। আইন-আদালত তার কাছে ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ। প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা তাঁর কাছে ছিলেন ছাপোষা। তার রুমে ঠাই হতো না সংবাদকর্মীদের। গণপূর্ত ঘিরে ছিলো নিজস্ব বলয়। তিনি এখন গণপুর্তের মুকটহীন সম্রাট। তার অফিস কক্ষে টাকা যেন বাতাসে উড়ে। তিনি যা চান তাই-ই করেন। পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেন। কমিশন ছাড়া সঁই করে না কোন ফাইল। ৫ আগষ্টের পর রাজনৈতিক ভোলপাল্টে আগের মতোই দাপট দেখাচ্ছেন তিনি। প্রকৌশলী হলেও তার হাত অনেক লম্বা। তিনি পারেন না, এমন কোনো কাজ নেই। আছে নিজস্ব গুন্ডা বাহিনীও। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা বেশ কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী।
দুর্নীতি,অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে আয় করেছেন শত কোটি টাকা। অন্যদিকে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগের ফান্ডে লাখ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এমকি নিজেই মাঠে নেমেছিলেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
সূত্র বলছে, অধিদপ্তর গণপূর্ত অধিদফতরে গত ১৭ বছর ধরে গড়ে উঠা লুটপাটের সিন্ডিকেটের মূল হোতা নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম। ঘুরেফিরেই ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আসলে ঢাকার গণপূর্তে যে মধু আছে সেই মধুর খোঁজে বিরামহীন ছুঁটছেন এই প্রকৌশলী।
সম্প্রতি ঢাকা সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। অভিযোগে বলা হয়, আতিকুল ইসলাম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ নির্বাহী প্রকৌশলীদের গডফাদার। ঘুরেফিরে ঢাকার এক ডিভিশন থেকে আরেক ডিভিশনে বদলি হন তিনি। ৩ বছর পরপর বদলীর বিধি থাকলেও গত ১৭ বছরে ঢাকার বাইরে বদলী হয়নি তার।
জানা গেছে, চাকুরী জীবনের প্রায় বিশ বছরের শিক্ষানবিশকাল বাদে পুরোটা সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন তিনি। বিগত দিনে মন্ত্রী, সচিব, প্রধান প্রকৌশলী আর প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কোটায় মূলত তিনি নিজের ইচ্ছামাফিক বদলি বাগিয়ে নিয়েছেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই তাকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ থেকে শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-৩ এ তাকে বদলি করা হয়। এ দুটি বিভাগই গণপূর্তের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং লোভনীয় পোস্টিং হিসেবে বলা হয় এ দপ্তরে।
আতিকুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলীর কর্মজীবনে সহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ডিভিশনে দীর্ঘ সময়ে কর্মরত ছিলেন। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০০৫ সালে বিএসসি সিভিল শেষ করেন। বিসিএস পাবলিক সার্ভিস ক্যাডার ২৭ ব্যাচে উত্তীর্ণ হয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী ২০১০ সাল থেকে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন আতিকুল ইসলাম। শিক্ষানবিশকালের ঐ সময়টুকু তিনি ঢাকার বাইরে চাকরি করেন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা-১ এ যোগদানের পর ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত একই পদে ছিলেন। তারও আগে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দুই দফায় দুই উপবিভাগে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন।
মাঝে ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষনাবেক্ষন বিভাগের কর্মরত ছিলেন। প্রভাবশালী ও আস্থাভাজন নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামকে টেন্ডার সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে দাবি করেন ঠিকাদাররা।
সূত্র জানায়, ঘুপচি টেন্ডার থেকে ‘বিশেষ ক্লোলাজ’ তার বিশেষত্ব, তাই বাইরে থেকে খালি চোখে এসব সূক্ষ্ম দুর্নীতি তেমন চোখে পড়েনা। দুর্নীতিবাজ আতিকুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছে ডাটাবেজ তৈরির কাজ। সংস্থাটির সকল ডিজিটাল এক্সেস কাজে লাগিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তার সকল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পুনরায় অডিট করলে অন্তত: ৫০ কোটি টাকার গরমিল পাওয়া যাবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে টেন্ডার বাণিজ্যে করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম।
অভিযোগ আছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষনাবেক্ষন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বিভিন্ন ঠিকাদারের নিকট হতে অধিক পরিমাণ উৎকোচ গ্রহণ করে অনুমোদিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা হতে ৩ বছরে তিনি প্রায় ৬০ কোটি টাকার অতিরিক্ত দরপত্র আহবান করে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ এ বদলী হয়ে চলে যান। এই অতিরিক্ত ৬০ কোটি টাকার দরপত্র আহবান করে সুকৌশলে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
একই সময় রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়ি ও তিনটি ভবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ) নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম। খরচ করার জায়গা না থাকলেও অর্থবছরে ১২০টি কাজের বিপরীতে রহস্যজনকভাবে ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন এই প্রকৌশলী। তা তখন নানা সমালোচনা জন্ম দেয়।
জানা যায়, সে সময় নিন্মমানের কাজ ও কাজ থেকে অর্থ আত্মসাৎ অভিযোগ তখনকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। মন্ত্রীকে টাকা দিয়ে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য একটি কমিটি করা হয়, এমন নজির আগে দেখাও যায়নি। শুধু মাত্র কমিশন বাণিজ্যই ছিল সে কমিটির মূল কাজ। কমিটির অনুমোদন নেওয়ার নামে মতিঝিল গণপূর্ত বিভাগ থেকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ এ হস্তান্তরে দুই বিভাগের মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুমোদন ফি নেওয়া হয়।
এভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে তিনি ময়ময়সিংহে ২৫ বিঘা জমির ওপর মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। যেটি তার শ্যালক পরিচালনা করছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় তার রয়েছে ১৪/১৫টি প্লট ও প্ল্যাট। দুদকের চোখকে ফাঁকি দিতে এসব সম্পত্তি তিনি বেনামে ক্রয় করেছেন। দুদক অনুসন্ধান করলেই তার থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামকে ফোন দিলে তিনি কল রিসিভ করেন নি। এমকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তার পাওয়া যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব বলেন, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। তাই তাদের নিমূল করা কঠিন।
এ বিষয়ে গণপূর্ত উপদেষ্টা মো: আদিলুর রহমান খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।