ইত্তেহাদ স্পেশাল

আমাদের সাবধানে থাকার কথা বলে সে গেল আন্দোলনে : শহীদ দুলালের স্ত্রী রুনা

image 209984 1750686588
print news

বাসস : ছাত্র আন্দোলনের কারণে বাসায় আসত না, অফিসেই থাকত। প্রতিদিনই ফোন দিত, বাচ্চাগো খোঁজ নিত। কিন্তু বেশি কথা হইত না, কয়েক মিনিট কথা বলত। তবে ওইদিন আমার সাথে ৩৩ মিনিট কথা বলেছিল। ওনার কথা যেন সেদিন শেষ হইতেছিল না। ছেলেদের, আমাকে সাবধানে থাকার কথা বলে সে গেল আন্দোলনে। আমাকে দুই ছেলের সব দায়িত্ব দিয়ে আমার জীবনটা অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল।’ কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদ সাইদুল হাসান দুলালের স্ত্রী রুনা পারভীন।

তিনি বলেন, ‘৩৩ মিনিটে আমারে সারা জীবনের দায়িত্ব দিয়া গেল। ফোন রাখার দশ মিনিট পরে আবার একটা ফোন আসে। আমি ভাবলাম আবার কেনো ফোন দিল! কিন্তু, ফোনের অপর পাশ থেকে কেউ একজন বলে, ‘আপনার স্বামী গুলি খাইছে, আপনি হাসপাতালে আসেন।’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে কুড়িল বিশ্বরোডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া গ্রামের সাইদুল হাসানের। তিনি গাজীপুরের টঙ্গীতে দারুল ইসলাম ট্রাস্ট আবাসনের একটি ফ্লাটে স্ত্রী রুনা পারভীন ও দুই ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন। সাইদুল হাসান বাধন হিজরা সংঘ নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কাজ করতেন।

রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া পুনবার্সন কেন্দ্রে টিনশেডের তিনকক্ষের একটি ঘরে সাইদুল হাসানের পরিবার বাস করেন। তারা দুই ভাই ও তিন বোন। বড় ভাই রাজ্জাক শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় সংসারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছিল সাইদুল হাসানের ওপর।

সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে সাইদুল হাসান দুলালকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার পরিবার। তার মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা পাগলপ্রায়। পুত্র শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। অভাব অনটনের সংসারে সাইদুল হাসান ছিলেন একমাত্র আশার আলো।

মা হাওয়াতুন নেসা বলেন, ‘আমি ছোট মেয়ের বাড়ি বরিশালে গেছিলাম দুলালের সাথে। গন্ডগোলের কারণে আমারে বরিশালে রাইখা ও চইলা আসে। মারা যাওয়ার আগেরদিন রাইতে ফোন দিয়ে বলে, মা তুমি চিন্তা কইর না। গন্ডগোল কমলে তোমারে নিয়ে আসুম বরিশাল থেকে। সবাই সাবধানে থাইক।’

তিনি বলে, ‘আমি তো জানতাম না। এটাই আমার ছেলের সাথে শেষ কথা। সবাইরে সাবধান কইরা আমার দুলালে গেছিল দেশ বাঁচাইতে। জালিমেরা আমার পাখিটারে মাইরা ফেলল। কই উইড়া গেল আমার পাখিডা! এক বুলেট আমার বুকডা খালি আর আমার নাতি দুইডারে এতিম করে দিল।’

সাইদুল হাসান দুলালের ছোট বোন নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমরা ভাই বোন কেউ তেমন স্বচ্ছল না। তাই আমার ভাই আমাদের সকলের দেখাশোনা করতেন। সকলেই তার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। আর বড় ভাই রাজ্জাক অনেক অসুস্থ , তার খরচও আমার ছোট ভাইয়া দিত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল শহীদ সাইদুল। কিন্তু তার স্ত্রী রুনা পারভীন ভয়ের কারণে বারবার তাকে আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করেন।

রুনা পারভীন বলেন, আমার স্বামী আমাদের দুই ছেলে রাফি (২০) ও রিদওয়ানকে (১৪) যেন বাড়ির বাহিরে যেতে না দেই, তার জন্য বারবার সাবধান করছে। বড় ছেলেকে আটকাতে পারিনি। সে আন্দোলনে যাইত। ছেলেকে নিয়ে ভয় পাইতাম। কিন্তু যে সাবধান করছে, সেও যে আন্দোলনে যাইত তা তো জানতাম না।’

তিনি বলেন, ‘আমারে বলত, আন্দোলনের কারণে যাতায়াতে সমস্যা তাই সে বাসায় আসে না। কিন্তু তারে অনেকবার বলেছিলাম, তুমি কিন্তু আন্দোলনে যাইও না। হয়ত সে জন্য সে যে মিছিলে যাইত, তা আমারে জানায় নাই।’

৫ আগস্ট সকালের সেই লোমহোর্ষক সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার সাথে সকালে কথা বলল। একটু পরে একজন ফোন দিয়ে বলে, আমার স্বামীর গায়ে গুলি লাগছে। কথাটা শুইনা আমার মাথায় যেন আকাশ ভাইঙ্গা পড়ল। ভাবতাছিলাম, ওনি না বলল অফিসে আছে, কেমনে গুলি লাগল?’

রুনা পারভিন বলেন, ‘তখন আমার কাছে তেমন টাকাও ছিল না। রাস্তার অবস্থা ভালো না বইলা ছেলেরা সাথে যাইতে চাইলেও ছেলেগো সাথে নেই নাই। একাই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যাই। গিয়া দেখি, আমার স্বামীরে জাতীয় পতাকা দিয়া ঢাইকা রাখছে। ডাক্তাররা তারে মৃত ঘোষণা করে দিছে।’

শহীদ সাইদুল হাসানের মরদেহ প্রথমে গাজীপুরে নিয়ে যায় তার পরিবার। সন্ধ্যায় সেখানে প্রথম জানাজা দিয়ে রাত এগারো টায় চনপাড়ায় নিয়ে যায়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা দিয়ে চনপাড়ায় স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

ছেলে রিদওয়ানকে বড় মাওলানা করার ইচ্ছা ছিল সাইদুল হাসানের। স্বামীর সেই ইচ্ছার ব্য়িয় জানিয়ে রুনা পারভীন বলেন, আমার ছোট ছেলেকে বড় মাওলানা করার ইচ্ছা ছিল আমার স্বামীর। ওর জন্যই আমরা গাজীপুরে থাকতাম। রিদওয়ান তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসায় পড়ে। বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তার ছেলে তার জানাজা পড়াইছে।

আমার স্বামীকে এখানে কবর দিতে চাইছিলাম। কিন্তু তার পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে চনপাড়া কবর দেওয়া হয়েছে।

শহীদ সাইদুল হাসানের স্ত্রী রুনা পারভীন আর্থিক সহায়তা পাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, আমরা জাময়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার সহায়তা পেয়েছি। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে শহীদ সাইদুল ইসলামের পরিবারকে দুই লাখ টাকার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে বলে জানায় তার পরিবার।

নিজের মানিকরতন ছেলেকে হারিয়ে শোকার্ত মা হাওয়াতুন নেসা বলেন, আমার পাখিডা (সাইদুল হাসান) দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। যারা আমার পাখির জীবন নিল আমি তাদের বিচার চাই। খুনিরা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.