বরগুনা জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি,এডিস মশার প্রজনন ৮ গুণ বেশি


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : চলতি বছর ঢাকার বাইরে বরগুনা জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। সেখানে এডিসের প্রজনন ভয়াবহ এবং এ মশার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ গুণ বেশি। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) এক জরিপেও এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির প্রধান কারণ বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি, বিশেষ করে বৃষ্টির জমা পানি। এ পানি এডিস মশা বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। জেলায় পানির সংকট বেশি থাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রবণতাও বেশি। বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে আইইডিসিআর মিলনায়তনে ‘ডেঙ্গু আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন ইন বরগুনা’ শীর্ষক এ জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২৬ জন।
জরিপের চিত্র তুলে ধরে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তাদের গবেষণা টিম ১৬ থেকে ২২ জুন (এক সপ্তাহ) সেখানকার (বরগুনা) ১৮৪টি বাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভা কীটতাত্ত্বিক জরিপ করে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। এর মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেখানে বরগুনা সদরে ব্রুটো ইনডেক্স ১৬৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর বরগুনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে এই সূচকের গড় ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশ।
জরিপে বরগুনা পৌরসভার ১৩৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৩১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব বাড়ির ৬৫টি পানির পাত্রে (কনটেইনার) ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া বরগুনা সদর উপজেলার (বিভিন্ন ইউনিয়ন) ৪৬টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৭৬ দশমিক ০৯ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব বাড়ির ৭৫টি কনটেইনারে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ১৬৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। এ সূচক স্বাভাবিকের চেয়ে সাড়ে ৮ গুণ বেশি।
বরগুনা পৌরসভার ৯ ওয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। পৌরসভায় ৭নং ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। এই ওয়ার্ডে ৮০টি বাড়ি জরিপ করে ব্রুটো ইনডেক্স ঘনত্ব পাওয়া যায় ১৫৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর ৯নং ওয়ার্ডের ১৩৩ দশমিক ৩৩, ২নং ওয়ার্ডের ৪০, ৮নং ওয়ার্ডের ৩৩ দশমিক ৩৩, ৬নং ওয়ার্ডের ৩১ দশমিক ২৫, ১নং ওয়ার্ডের ১৩ দশমিক ৩৩ এবং ৩ ও ৫নং ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
জরিপে আরও দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ একতলা, ৩৩ শতাংশ আধা-পাকা ভবন, ৯ শতাংশ বহুতল ভবন এবং ২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী উপকরণ পাওয়া গেছে। জরিপ এলাকার যেসব বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রাম এবং ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বালতি ছিল মূল ‘ব্রিডিং সোর্স’। এগুলো মূলত জমানো পানির জন্য ব্যবহৃত হয়।
বরগুনায় জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৪, মার্চে ১২, এপ্রিলে ১৬৫, মেতে ৬৬৪ এবং চলতি মাসের (২৫ জুন) বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৯ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, বরগুনায় ৪৩টি নমুনা পরীক্ষা করে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২০ জনের শরীরে ডেঙ্গুর ডেন-৩ সেরোটাইপ (৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ) পাওয়া গেছে। এরপর ১৭ জনের শরীরে পাওয়া গেছে ডেন-২ সেরোটাইপ (৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ)। এর বাইরে ৬ জনের নমুনায় ডেন-২ ও ডেন-৩ সেরোটাইপ (১৪ দশমিক শূন্য শতাংশ) তথা কো-ইনফেকশন (সহসংক্রমণ) পাওয়া গেছে। কো-ইনফেকশন বা সহসংক্রমণ প্রতিবছরই কমবেশি পাওয়া যায়। তবে বরগুনার নমুনায় একটিতেও চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, চিত্রটা কতটা ভয়াবহ, আমরা এখনো পুরোপুরি বলতে পারছি না। তবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে, যদিও মৃত্যুহার কম থাকবে। বরগুনায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আটজন চিকিৎসক ও দুইজন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়।
আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রত্না দাস বলেন, উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় বরগুনায় সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা আছে। সেখানকার মানুষ বৃষ্টির মৌসুমে ড্রাম, মটকা, বালতিসহ বিভিন্ন পাত্রে পানি ধরে রাখে। কিন্তু এসব পানি ঢাকনা দিয়ে না ঢেকে পাতলা কাঁপড় দিয়ে রাখে। নিয়ম অনুযায়ী সংরক্ষিত পানি এক বা দুইদিন পর ফেলে দিয়ে পাত্রটি পরিষ্কার করে নতুন পানি জমা করা উচিত। কিন্তু তারা অবশিষ্ট পানি ফেলে না দিয়েই একই পাত্রে পুনরায় পানি সংরক্ষণ করে থাকে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকেও জানানো হয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্তরা বাড়িতে মশারি ব্যবহার করছেন না। আরেকটি বিষয়, ঈদের সময় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে। জেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ায় মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
ডেঙ্গুতে আরও ২ মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২৬ : এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২৬ জন। এ নিয়ে চলতি বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। তাদের মধ্যে চলতি জুনেই মারা গেছেন ১৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ নিয়ে টানা পাঁচ দিন দৈনিক তিনশর বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এর আগে শনিবার ৩৫২, রোববার ৩২৯, সোমবার ৩৯২ এবং মঙ্গলবার ৩৯৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছর ৮ হাজার ৮৭০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চিকিৎসার জন্য। যারা আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে যাননি অথবা পরীক্ষা করাননি, তাদের তথ্য এ তালিকায় আসেনি।
গত একদিনে যে দুজন মারা গেছেন, তাদের একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং একজন রাজশাহী বিভাগের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নতুন রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১৮ জন বরিশাল বিভাগের।
এছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭৩, ঢাকা বিভাগে ৪১, ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৩, খুলনা বিভাগে ১৬, রাজশাহী বিভাগে ২৯ এবং সিলেট বিভাগে একজন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১০৮৫ জন। এ বছর এটাই একদিনে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। তাদের মধ্যে ৩১৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং ৭৬৭ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।