বাংলাদেশ ঢাকা

ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিল, এক উপদেষ্টার দাবি নাকচ করলেন আরেক উপদেষ্টা

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন :  আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে হওয়া ১০টি প্রকল্প ও চুক্তি বাতিল করা হয়েছে বলে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা পুরোপুরি ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন। তবে ভারতীয় ঋণে টাগবোট কেনার একটি চুক্তি বাতিল ও আরো কিছু পর্যালোচনায় রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে রবিবার দেয়া একটি পোস্টে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দাবি করেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের সাথে করা ১০ চুক্তি বাতিল, বাকিগুলোও বিবেচনাধীন।

পোস্টটিতে প্রকল্পগুলোর নাম উল্লেখ করে বলা হয়, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পরই চুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”

যদিও এই তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে এখন পর্যন্ত একটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া আরো কয়েকটি প্রকল্প ও চুক্তির বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।এ সময় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পোস্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

এ বিষয়ে মতামত জানতে বিভিন্নভাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।তবে তার এই ফেসবুক পোস্ট নানা আলোচনা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শীতল সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব কেমন হবে সেই বিষয়টিও সামনে আসছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অনেক অবনতি হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও।এমনকি বিগত সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে হওয়া সব কটি চুক্তি সরকারের প্রকাশ করার পাশাপাশি দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো বাতিলের দাবিও তোলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।

গত এক বছরে ভারতও বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়ার হার কমানো, নানা কারণে সীমান্ত উত্তেজনা, পুশইন এবং ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থাও প্রত্যাহার করে।

এমন প্রেক্ষাপটে চুক্তি বাতিল হওয়া ও আরো কিছু চুক্তি বা সমঝোতা পর্যালোচনায় থাকার তথ্য সামনে এলো।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূতদের কেউ কেউ বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এই মুহূর্তে ভালো যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সমঝোতা ও চুক্তিগুলো কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাতিল করা হলে তা দুই দেশের সম্পর্কের উপর আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের যে পোস্টটি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সামাজিক মাধ্যমে দিয়েছিলেন সেখানে দেশটির সঙ্গে ১০টি চুক্তি বাতিলের দাবি করা হয়েছে।তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া ফটোকার্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম রেল সংযোগ প্রকল্প, অভয়পুর-আখাউড়া রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্প, আশুগঞ্জ-আগরতলা করিডর প্রকল্প, ফেনী নদী পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ও পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন সম্প্রসারণ চুক্তিসহ দশটি প্রকল্প ও চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।

এছাড়া আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিও পূণর্বিবেচনা করা হবে বলে ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে।সোমবার এ বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মি. হোসেন বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর ভারতের সঙ্গে এখন পর্যন্ত, ভারতীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানি- জিআরএসই এর সঙ্গে টাগ বোট কেনার চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলো প্রকল্প ও চুক্তি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে বলে জানান তিনি।

উপদেষ্টা জানান, সামাজিক মাধ্যমে উল্লেখ করা কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন প্রকল্প, বন্দরের ব্যবহার সংক্রান্ত সড়ক ও নৌপথ উন্নয়ন চুক্তি, ফারাক্কা বাঁধ সংক্রাক্ত প্রকল্পে বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগীতার প্রস্তাব, সিলেট শিলচর সংযোগ প্রকল্প, পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন সম্প্রসারণ চুক্তি এসব নামে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তিই নেই। আশুগঞ্জ-আগরতলা করিডর নামে কোনও প্রকল্প নেই। তবে আশুগঞ্জ-সরাইল-খারখার প্রকল্প আছে, যার মধ্যে ধারখার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর প্যাকেজ বাতিল করা হয়েছে।

ভারতীয় ঋণ চুক্তির আওতায় মিরসরাই ও মোংলায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি বাতিলের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

তবে আদানি পাওয়ার চুক্তি পুনর্বিবেচনার জন্য আলোচনা হচ্ছে, আর গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের আলোচনা হবে এবং এজন্য যোগাযোগ হচ্ছে বলে জানান উপদেষ্টা। এছাড়া তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির খসড়া নিয়ে আলোচনা চলছে, যদিও তাতে খুব বেশি অগ্রগতি নেই।

তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা ভিত্তিতে চুক্তিতে থাকা ক্লজ অনুসারেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

মি. হোসেন বলেন,”লাভবান হওয়ার জন্যই চুক্তি করা হয়, কিন্তু পর্যালোচনা এবং পূনর্বিবেচনা করা হয় যখন দেখা হয় যে সেটি ঠিক মতো কাজ করছে না অথবা অগ্রগতি হচ্ছে না।”

চাইলেই কি চুক্তি বাতিল করা যায়?

আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিলের নির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ভর করে এর শর্তাবলীর ওপর। সাধারণত বাতিলের পদ্ধতিও চুক্তিপত্রের অংশ হিসেবেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে।

এক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, উভয় পক্ষের সম্মতিতে বাতিল করা, একটি পক্ষের চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অথবা চুক্তিটি অবৈধ বলে গণ্য হওয়া- এমন নানা বিষয় বাতিলের কারণ হতে পারে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে, চুক্তির শর্তাবলী পূরণ করতে না পারলেও সেটি বাতিল হতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, কোনও দেশ চাইলে চুক্তি বাতিল করতেই পারে কিন্তু এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্টান্ডিং বা এমওইউ এবং চুক্তি এই দুইটি বিষয়ের গুরুত্ব ভিন্ন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন, এমওইউ বাতিল করাটা সহজ। তবে যদি অ্যাগ্রিমেন্ট বা চুক্তি হয় তখন চুক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়।

এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী বাতিল করার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং কি কারণে বাতিল হবে তার লাভ-ক্ষতির বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বাতিল যে করা যাবে না তা নয়। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে একপক্ষ এমনিতেই বাতিল করলো, ডিসকাশনও করলো না, কেবল চিঠি দিয়ে দিল যে আমি চাই না, তাহলে বিষটি একটি ডিপ্লোমেটিক টাসেলে বা কূটনৈতিক ঝগড়ার মধ্যে পড়ে।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলছেন, স্বার্থ বিঘ্নিত হলে যে কোনও পক্ষই চুক্তিটি বাতিল করতে পারে। ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলে, তারাও তো বেশ কিছু বিষয়ে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে।

তবে এমন সিদ্ধান্ত কোনো দেশের জন্যই ভালো নয় বলেও মনে করেন তিনি। “এখন আমাদের দুই দেশের সম্পর্কতো ভালো না, তবে এটি কারো জন্যই সুখকর হবে না।”

কূটনৈতিকভাবে কী প্রভাব ফেলতে পারে?

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ-ভারত। এমনকি ভিসা জটিলতার কারণে দুই দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক যাতায়াতের বিষয়টিও এখন বাঁধাগ্রস্ত।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এমনিতেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। দুই দেশের রাজনীতিক এবং নাগরিক পর্যায়েও কথার লড়াই হয়েছে নানা সময়।

এছাড়া সীমান্ত উত্তেজনা, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে পুশইনসহ নানা ঘটনাও ঘটেছে এই সময়ে।

এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি বাতিল এবং আরো কিছু চুক্তি বা সমঝোতা পূনর্বিবচনার বিষয়টি সামনে এলো। যা দুই দেশের জন্যই অস্বস্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, দুই দেশেরই উচিৎ হবে যে চুক্তিগুলো আছে তা সচল রাখা এবং নতুন চুক্তির দিকে এগোনো। প্রয়োজনে যেখানে সমস্যা আছে সেটি পূনর্মূল্যায়ণ করা যেতে পারে, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।

চুক্তি বাতিল না করে বরং সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই দেশেরই আগ্রহী হওয়া উচিৎ বলেই মনে করেন তিনি। বলছেন, “ভারত বড় দেশ, তাদের সহ্য করবার শক্তি অনেক বেশি। তারা ক্ষতি সহ্য করেও বিভিন্নভাবে হয়তো আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে।”

“দুই দিন পরপর আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারত আবার পাল্টা সিদ্ধান্ত নিল এটি করে আমাদের কী লাভ,” বলেন মি. আহমেদ।

তবে দুই পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে চুক্তিগুলো বাতিল করলে খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।

তবে যদি আলোচনা ছাড়াই একপাক্ষিকভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে এটি কূটনৈতিকভাবে ভালো ফল বয়ে আনবে না।”একতরফা কিছু হলে ভারতও এক্ষেত্রে রিঅ্যাকশন দেখাবে। সেটি আমরা কিভাবে সামাল দিব সেই প্রস্তুতি রাখা দরকার,” বলেন মি. আহমেদ।

বিবিসি নিউজ বাংলা

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.