বরিশালের পাঁচ সংসদ সদস্যের পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণ


বরিশাল অফিস : বরিশাল জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের চারটিতে আওয়ামী লীগ এবং দুটিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে একটি আসন বাদে বাকি পাঁচটিতেই বর্তমান সংসদ সদস্যরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বরিশালের একটি আসনে। তারা সবাই নির্বাচন কমিশনে হলফনামা জমা দিয়েছেন।
হলফনামার তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন সংসদ সদস্যেরই আয় বেড়েছে দ্বি-গুণ থেকে বহুগুণ। এমনকি তাদের স্ত্রী-সন্তান এবং নির্ভরশীলদের আয়ও বেড়েছে। সবারই স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকার ওপরে। তবে একমাত্র বরিশাল-৬ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রতনা ওরফে রতনা আমিনের সম্পদ গত পাঁচ বছরে অর্ধেকে নেমে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বরিশালের ছয়টি সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের মধ্যে সাতজনই হলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার।
এছাড়া অপর বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীরা হলেন, বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ মনিরুল ইসলাম মনি, বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনের জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ গোলাম কিবরিয়া টিপু, বরিশাল-২ ও ৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী খান আফতাফ হোসেন ভুলু এবং ঋণ খেলাপীর দায়ে মনোনয়ন বাতিলের পর আপিল করা স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুল আলম চুন্নু। এ সব বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীরা আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারলে তারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে যাচাই বাছাই শেষে বৈধ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে থাকা ৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৩ জনই হলেন ব্যবসায়ী। রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে দাখিলকৃত হলফনামার এ তথ্য জানা গেছে। এরমধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র ও বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ তার পেশা হিসেবে মৎস্য চাষ ও রাখি-মালামালের ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন।
ব্যবসায়ী প্রার্থীদের মধ্যে পাঁচজন রয়েছেন যারা ব্যবসার পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি ও প্রতিষ্ঠানের মালিক। সূত্রমতে, ২৩ জন ব্যবসায়ী প্রার্থী ব্যতিত পাঁচজন রাজনীতিবিদ, চারজন আইনজীবী, দুইজন বেসরকারি চাকরিজীবী, দুইজন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, দুইজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, একজন সাংবাদিক ও লেখক, একজন পেশাদার সংগীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার, একজন কবি ও লেখক, একজন পরামর্শক, একজন কৃষি ও মৎস্য চাষ এবং একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেদের পেশার কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া এসএসসি ও সমমান পাশ করেছে এমন রয়েছেন চারজন, এইচএসসি পাশ করেছেন চারজন, বাকিদের মধ্যে অনার্স বা সমমান থেকে মাস্টার্স বা সমমান পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে ২৮ জনের। আর একজন রয়েছেন পিএইচডি ধারী।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) :
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জেলার গৌরনদী এবং আগৈলঝাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ২০১৩ সালে তার হলফনামায় দেখা যায়, ওই সময় তিনি তার বাৎসরিক আয় দেখিয়েছিলেন ২৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ওপরে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আয় দেখানো হয় ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বেশি। এবারের ২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন চার কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি।
এ ছাড়া দুটি জিপগাড়িসহ মোট ৩৩ কোটি ৫২ লাখেরও বেশি টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং এবং ১ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি টাকা মূল্যের ১৭ একর কৃষি জমি, ৪১.০৪৯ একর অকৃষি জমি, ঢাকার কলাবাগানে ১টি দালান ও যৌথ নামে নিজ গ্রামে পৈত্রিক বাড়ির একাংশ দেখানো হয়েছে স্থাবর সম্পদের বিবরণে। তবে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে সম্পদের হিসাব শূন্য।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) :
আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য শাহে আলম। তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি। ফলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও অংশগ্রহণ করেননি নির্বাচনে।
বরিশাল-৩ (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) :
আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। গত পাঁচ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৮ সালের হলফনামায় তার বাৎসরিক আয় ছিল ৬ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি। এবারের নির্বাচনে তিনি আয় দেখিয়েছেন প্রায় ১৯ কোটি টাকা।
তাছাড়া ২০১৮ সালে প্রায় ৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুর। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি টাকার ওপরে। এমনকি পূর্বের নির্বাচনে স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ না থাকলেও এবারের নির্বাচনে স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৪ কোটি টাকার ওপরে।
একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ঢাকা-৮ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। হলফনামায় বর্তমানে তিনি তার আয় দেখিয়েছেন আয় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৫ টাকা। যা ২০১৮ সালে ছিল ১২ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা। পূর্বের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছিলেন ৭৫ লাখ ৭৮ হাজার ৩৩৭ টাকা। গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে ৩৭ কোটি ৮১ লাখ এক হাজার ১৪২ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া গত নির্বাচনে স্থাবর সম্পত্তি পরিমাণ ৩৭ লাখ ২০ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন। তবে গত পাঁচ বছরে স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ একই অবস্থানে রয়েছে।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) :
আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের পংকজ নাথ। তবে এবারের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
তবে মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ নাথ। গত পাঁচ বছরে যার আয় বেড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি তার বাৎসরিক আয় দেখিয়েছিলেন ৩৫ লাখেরও বেশি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার আয় বেড়ে ৪৩ লাখেরও বেশি টাকা হয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমানে ২৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫ হাজার ১৭১ টাকা মূলের অস্থাবর সম্পত্তি এবং রাজউকের পূর্বাচলে ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের (প্লট) স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি ৫৯ হাজার ৬১৪ টাকা মূল্যের অস্থাবর এবং ৬৬ হাজার ২১ হাজার ৯১৩ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছিলেন। সে হিসেবে তার এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে।
বরিশাল-৫ (বরিশাল সদর) :
এদিকে সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন গিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক শামীম। তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। আসন্ন নির্বাচনেও নৌকার টিকিট পেয়েছেন জাহিদ ফারুক।
২০১৮ এবং আসন্ন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের হলফনামা বলছে, গত পাঁচ বছরে জাহিদ ফারুক শামীমের সম্পদ এবং আয় বেড়েছে বহুগুণ। ২০১৮ সালে তাঁর বাৎসরিক আয় ছিল সাড়ে চার লাখেরও বেশি টাকা। গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে দেড় কোটির বেশি হয়েছে। এমনকি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে তার। ব্যক্তিগত গাড়িসহ ২ কোটি ৭ লাখ টাকার বেশি সম্পদের মালিক তিনি। তার স্ত্রীরও রয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার বেশি অস্থাবর সম্পদ। রয়েছে নাল জমি, ভিটাবাড়ি ও দুটি স্থাবর সম্পদ। যার মূল্য কোটি টাকার ওপরে।
একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ। যিনি বরিশাল সিটির সদ্য সাবেক মেয়র। সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় হলফনামায় তিনি বাৎসরিক আয় দেখিয়েছিলেন ৮ লাখ ৩১ সহস্রাধিক টাকা। বর্তমানে তার সেই আয়ের পরিমাণ বেড়ে ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়েছে।
তাছাড়া ২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনের সময় হলফনামায় তিনি ১টি রিকন্ডিশন মাইক্রোবাস, কিছু আসবাবপত্রসহ ৮ লাখ ৮১ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন। আর স্থাবর সম্পদের তালিকায় ছিল অকৃষি জমির খাতে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে রাজউকের প্লট ও গুলশানের নিকেতনে ফ্ল্যাট। এবারের হলফনামায় অস্থাবরে নিজ নামের ঘরে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকার অধিক সম্পদ এবং তাঁর স্ত্রীর নামে সাড়ে ৩ লাখ টাকা মূল্যের ১০ ভরি স্বর্ণের কথা উল্লেখ করেছেন।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) :
জেলার একমাত্র নারী সংসদ সদস্য বরিশাল-৬ আসনে নাসরিন জাহান রতনা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আবারও আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। তবে ক্ষমতার গত পাঁচ বছরে তাঁর আয় এবং সম্পদের পরিমাণ অর্ধেকে নেমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়।
হলফনামা বলছে, বর্তমানে এ সংসদ সদস্যের বাৎসরিক আয় ৩০ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৯ টাকা। ২০১৮ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯৬ টাকা। ওই সময় নিজের দুটি ল্যান্ড ক্রুজারসহ চার কোটি ৩২ লখ ৮৪ হাজার ৩২৪ টাকা মূল্যের অস্থাবর এবং ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৭ টাকা মূল্যে অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে অস্থাবর সম্পত্তি ৩৬ কোটি ৮১ লাখ এক হাজার ৪২৩ টাকার এবং ৮৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪২ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছেন।
*গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news