ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

কাঠগড়ায় দুদক কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম : অনুসন্ধানে ৩ সদস্যের টিম

mahbubul 20230810190827
print news

 

গুরুতর অভিযোগে এবার কাঠগড়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পদস্থ এক কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্য ও ইয়াবা কারবারের অভিযোগ আমলে নিয়ে বুধবার অনুসন্ধান দল গঠন করেছে কমিশন।

দুদক পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দলের অন্য দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক নেয়ামুল গাজী। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগের তির, তিনি হলেন উপপরিচালক মুহ. মাহবুবুল আলম।

বৃহস্পতিবার এ খবর জানাজানি হলে সংস্থার ভেতরেই তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দুদকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগ এলে শুরুতে ‘ইন্টারনাল’ তদন্ত হয়। তার (মাহবুবুল আলম) বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর গোপন তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান দল টিম গঠনের বিষয়টি আমার জানা নেই।

জানা যায়, মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো তিনি মরণনেশা ইয়াবা কারবারে জড়িত। চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান এনে বরগুনা ও বরিশাল এলাকায় সরবরাহ করেন। মাদক বাণিজ্যের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে উলে­খযোগ্য অভিযোগগুলো হলো-চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ কর্মরত থাকাকালে তিনি ঘুস বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর ট্র্যাপ কেসের মাধ্যমে মহেশখালী সদর উপজেলার কানুনগো আবদুর রহমানকে নগদ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্ট্যাম্পসহ গ্রেফতার করা হয়।

ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মাহবুবুল আলম। তিনি জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। তিন বছর পর আদালতের নির্দেশে ওই টাকা জমা দেন। অথচ জব্দ করা ওই টাকা ছিল ফাঁদ মামলার আলামত।

এছাড়া দুদকের চাকরিচ্যুত আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ ২০২১ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হওয়ার পর তার আলোচিত প্রতিবেদনগুলো চার মাস নিজের কাছে রেখে দেন মাহবুবুল আলম।

ওইসব প্রতিবেদন মোটা টাকার বিনিময়ে তিনি মামলার আসামিদের কাছে সরবরাহ করেন। আসামিদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঘুসের টাকায়ই তিনি তখন পটুয়াখালী ও ঢাকায় সম্পদ কেনেন। তার অবৈধ সম্পদের সত্যতা দুদকের গোপন তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুবুল আলমের নামে দান ও কেনাসূত্রে ১৮টি দলিলে ৪৫৫ শতক জমি এবং ২০ লাখ ১ হাজার ৩০০ টাকা বিনিয়োগসহ ২৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯১ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর গলাচিপা আড়তপট্টিতে ছয়টি দোকান কিনেছেন তিনি। গ্রামে এক কোটি ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা মূল্যের কৃষি জমি রয়েছে তার।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাহবুবুল আলমের স্ত্রীর নামে ১৪টি দলিলে ৩৫৪ শতক জমি কেনার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া একটি কোম্পানিতে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। তার মেয়ের নামেও সাতটি দলিলে ১৪৫ দশমিক ৮৮ শতক জমি, ২৬ লাখ টাকার গাড়ি কেনা ছাড়াও পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগসহ অন্যান্য সম্পত্তি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া এক অভিযোগে বলা হয়েছে, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় তার জমি ও তিনতলা একটি ভবন রয়েছে। এছাড়া বরগুনার আমতলীর সোনাখালী গ্রামে তার বসতবাড়িতে দুইতলা ভবন, পটুয়াখালীর পায়রাবন্দরের পাশে কলাপাড়ায় কয়েকশ বিঘা জমি, আমতলী উপজেলায় কয়েকশ বিঘা ধানী জমি ও তিনটি দীঘি, ঢাকার শান্তিনগরে তার টাকায় ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে সাততলা এবং রামপুরায় ছয়তলা ভবন রয়েছে।

অন্যদিকে নয়াপল্টন এলাকায় চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী নামে ২০ তলা মার্কেটে ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে শেয়ার, আমতলী উপজেলায় বাড়ি, হাবিবুর ও তার ছেলের নামে নতুন-পুরাতন গাড়ির শো-রুম, মিরপুরে দীপ্তি আবাসন প্রকল্পের নিকট আত্মীয়ের নামে শেয়ার, সেখানে মালিক দেখানো হয়েছে ফারুক মৃধা, নজরুল ও মশিউরসহ আরও কয়েকজনকে। এছাড়া বোন, বোন-জামাই, ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নামে, শ্যালক ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামেও ঢাকা ও পাবনায় শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে তার। অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, তার নিজ উপজেলা আমতলীর একটি স্কুল ও কলেজে এডহক কমিটির সভাপতি পদ নিয়েও তিনি আইন-বহির্ভূত প্রভাব খাটাচ্ছেন।

অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের ৯০ ভাগের মালিক হন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ চার বছর কর্মরত অবস্থায়। শুধু তাই নয়, কেজিডিসিএল-এর মামলার সুপারিশ করা প্রতিবেদন পরিসমাপ্তির সুপারিশ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসাবে আসামিদের কাছ থেকে তিনি বিপুল অঙ্কের ঘুস নেন।

অভিযোগ আছে, বর্তমানে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত এই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু মাহবুবুল আলম প্রভাব খাটিয়ে সেটি আটকে দেন। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠিতে কমিশন তার যে পরিমাণ অবৈধ সম্পদের কথা উল্লেখ করেছে, তার চেয়ে অনেক কম অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হলো-লোহাগড়ার সাবেক ওসি শাজাহানের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান দলের প্রধান ছিলেন মাহবুবুল আলম। ওই অনুসন্ধানটি নথিভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাজাহানের কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেন।

শাজাহান বাধ্য হয়ে দুদফায় তাকে ৭২ লাখ টাকা ঘুস দেন। তার কক্সবাজারের এজেন্ট মুবীনের মাধ্যমে ঢাকার শান্তিনগরে মাহবুবুল আলমের বাসায় এই টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু দাবি করা ঘুসের পুরো টাকা না পেয়ে রতন কুমার দাসকে দিয়ে শাজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে দেন।

এছাড়া ২০১৯ সালে ট্র্যাপ কেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম এলএ শাখার চেইনম্যান নজরুলকে নগদ ৮ লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ এলএ চেকসহ গ্রেফতার করা হয়। তিনি ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও অবৈধ সুবিধা নিয়ে চার বছর ধরে তিনি মামলাটি আটকে রাখেন।

জানতে চাইলে মুহা. মাহবুবুল আলম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘অনুসন্ধান দল গঠন করার বিষয়টি আমিও শুনেছি। এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। শুধু বলব, কে বা কারা আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, তা আমার জীবনের সঙ্গে যায় না।’

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *