আবুল কালামের শিশু সন্তানদের মানুষ করতে চাকরি করবেন প্রিয়া, কি করে বইবেন বেদনার ভার!

বাসস: স্বামীর অকাল মৃত্যুতে দিশেহারা নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া। প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ছে, ‘সেদিন যাওয়ার সময় কেন নিজে বিদায় দিলাম না!’ এমনি কত খুটিনাটি স্মৃতি ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। তবুও দুটি শিশু সন্তানকে মানুষ করতে হবে প্রিয়াকে। নিজেকেও বাঁচতে হবে।
সন্তানদের মানুষ করে তুলতে তাই নিজে একটি চাকরি করতে চান।সরকার ইতোমধ্যেই নিহত আবুল কালামের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
কিন্তু এসব ক্ষতিপূরণে কি প্রিয়ার হৃদয়ের সান্ত্বনা মিলবে? এই যে শেষ কথা বলার সুযোগটা হলো না! রইলো না শেষ দেখার উষ্ণতা! এ ভার কী করে বইবেন প্রিয়া?
ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় গত রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে মেট্রোরেলের বেয়ারিং প্যাড খুলে মাথায় পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠী গ্রামের আবুল কালাম আজাদ (৩৬)। তার এক ঘণ্টা আগেই বাড়িতে ভাবির সাথে কথা বলেছেন। আগামী পরিকল্পনার কথা বলেছেন। আর এক ঘণ্টা পর তার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে কালামের পরিবার।
নিহত আবুল কালামের ভাবী আসমা বেগম জানান, তার সাথে কালামের শেষ কথা হয় ঘটনার দিন বেলা ১১টায়। অতি শীঘ্রই বাড়ি ফিরে দেখা করবেন সবার সাথে। সেই বাড়ি ফেরা হলো লাশ হয়ে। ছয় বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আবুল কালাম ছিলেন সবার ছোট। স্ত্রী ও দুই শিশু সস্তান নিয়ে বসবাস করতেন নারায়ণগঞ্জের পাঠানতলি এলাকায়। ঢাকায় তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতেন। তার আয়ের একটি অংশ গ্রামের বাড়িতে পাঠাতেন ভাইদের জন্য। রোববার বেলা ১২টার দিকে রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার সময় মেট্রোরেলের বেয়ারিং প্যাড খুলে তার উপর পড়লে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
দুই সন্তানের জনক আবুল কালাম নিজেও কি জানতেন তার সন্তানদের ভাগ্যের নির্মম পরিণতির কথা? জীবনের শেষ ক্ষণে কী ভাবছিলেন তিনি? কেউ কোনোদিন জানবে না আর!ঘটনার পর খবর পেয়ে যোগাযোগ উপদেষ্টা মো. ফয়জুল কবীর ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা ও পরিবারের যোগ্য লোককে চাকুরি দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায্য বিচার চায় পরিবার। যাতে কারো দায়িত্বে অবহেলার জন্য আর কারো জীবন অকালে চলে না যায়।
নিহত কালামের বড় ভাই খোকন চোকদার বলেন, আমার উপার্জনক্ষম নিরপরাধ ভাইটি কার দায়িত্ব অবহেলার জন্য মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে! আমরা এর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায় বিচার চাই।
নড়িয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লাকি দাস বলেন, এ দুর্ঘটনার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। নিহতের পরিবারকে সমবেদনা জানাই। পাশাপাশি সরকারের উচ্চমহল এ বিষয়ে পরিবারের জন্য সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে সার্বিক সহায়তা করবেন বলেও তিনি জানান।
জানা যায়, নিহত আবুল কালামের মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তিনি ভাই বোনদের কাছে বড় হয়েছেন। তাই ভাই- বোনদের তিনি বাবা মায়ের মতোই সম্মান করতেন। তাদের প্রতি মমতা ও দায়িত্ববোধ ও ছিল প্রবল। তার ৬ বোন ৪ ভাই। এক ভাই বিদেশে চাকুরিরত অবস্থায় অনেক আগেই মারা গিয়েছেন ।
কালাম-প্রিয়া দম্পতির এক ছেলে আবদুল্লাহ (৫) এবং মেয়ে সুরাইয়া (৩)। স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেছেন। স্বামী শোকে বিহ্বল প্রিয়ার সাথে কথা বলা সম্ভব না হলেও তার নিকট আত্মীয়রা জানান, সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করার জন্য চাকরি করতে চান প্রিয়া।
কালামের মরদেহ সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে তার গ্রামের বাড়ি আনার পর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে সেখানেই তার দাফন সম্পন্ন হয়। স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেউই এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।
এর আগে ময়নাতদন্ত শেষে রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি পৌঁছানোর পর পরিবার-পরিজন, পাড়া প্রতিবেশীসহ হাজার হাজার মানুষ এক নজর দেখার জন্য সেখানে ভিড় জমায়। স্ত্রী প্রিয়ার আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন নি সেসময়।
সোমবার সকাল ৯টায় তার গ্রামের বাড়ির পাশে মোক্তারের চর পূর্ব পোড়াগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে দ্বিতীয় জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইমরুল হাসানসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই সেখানে হাজির হয়। সবাই পরিবারের লোকজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।নিহত আবুল কালামের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। স্বজনরা কেউ মেনে নিতে পারছেন না এ অকাল মৃত্যু।


