ঢাকা বাংলাদেশ

ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগের নামে প্রতারণা :দুনিয়া-আখিরাতের অফার হিলটনের, অন্যদের হিরো

image 17579 1692846898
print news

এমটিএফইর প্রতারণা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যেই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আরও অর্ধশতাধিক প্ল্যাটফর্ম। দেশে ও দেশের বাইরে সক্রিয় থাকা মাঠ পর্যায়ের এজেন্টদের দিয়ে পাতা হচ্ছে প্রতারণার ফাঁদ। রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন তো আছেই, সাধারণ মানুষের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করতে ধর্মীয় অনুভূতিকেও ব্যবহার করছেন কেউ কেউ।

হিলটন মেটা এফএক্স নামের একটি প্ল্যাটফর্মের দাবি, তাদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে নিশ্চিত হবে দুনিয়া ও আখিরাত। আর ‘জিরো থেকে হিরো’ বানিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছে আলটিমা টোকেন, ট্রেস্ট এনটিএফই, ফিউচার ক্যাপিটাল এফএক্স, ওয়েলাই ডট কম, রেয়ানা মেটা এফএক্স, ইসি ব্রিলিয়ান্টসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। পরিচয় ও অবস্থান গোপন রাখতে যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম অ্যাপ ব্যবহার করছে এসব চক্র।

হিলটনের আগেও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কারসাজিতে ইলিয়াসের ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। তবে ইলিয়াস নিজে বেশিরভাগ সময় মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। প্রথমে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের হিলটনে যুক্ত করান। তারপর তাদের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক বিস্তার করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ধর্মকে ব্যবহার করছে হিলটন মেটা এফএক্স। গত বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় ইসিয়াস বলেন, ‘আপনারা হিল্টন করুন, হিল্টনের সঙ্গে থাকুন, হিল্টনের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণ করুন; উপভোগ করুন এবং আয় করুন। দুনিয়ায় আপনাদের সর্বোচ্চ অবস্থান হোক, আখিরাতেও সর্বোচ্চ স্থান হোক।’

ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে ধর্মভীরু মুসলমানদের বিশ্বাস অর্জনে বিভিন্ন সময় ভিডিও বার্তায় এ ধরনের কথা বলে আসছেন ইলিয়াস। এর মাঝে আছে তার মাধ্যমে বছরে ১ কোটি টাকা জাকাত প্রদানের সক্ষমতা অর্জনে আল্লাহর দোয়া কবুল, ইসলামের খাদেম হাওয়া এবং তার মাধ্যমে মুসলিমদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করার মতো দাবি। এ ছাড়াও হিলটনে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভনও দেখান তিনি। এজন্য কখনো দুবাই, আবার কখনো মালদ্বীপ থেকে ভিডিওবার্তা পোস্ট করেন।

প্রতারণার মাধ্যমে বেশিসংখ্যক বিনিয়োগকারী আকর্ষণে এবার বিনামূল্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ফরেক্স ট্রেডিং প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ইলিয়াসের প্রতিনিধিরা। আর এসব প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং যাবতীয় যোগাযোগ হয় হোয়াটসঅ্যাপে। আনোয়ার হোসেন নামের এমন একজন প্রশিক্ষকের সাথে যোগাযোগ হয় এই প্রতিবেদকের। সেখান থেকে প্রতিবেদক যুক্ত হন ফরেক্স ট্রেডিং শেখার গোপন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে। সেই গ্রুপে জানা যায়, প্রথমে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের নামে মানুষ জড়ো করে পরে তাদের থেকে চাওয়া হয় বিনিয়োগ।

এক ফেসবুক পোস্টে হিলটন মেটা এফএক্স-এর বিনিয়োগের নিয়ম তুলে ধরে ইলিয়াস জানান, ১০ ডলার দিয়ে খোলা যাবে অ্যাকাউন্ট আর ১০০ ডলার বিনিয়োগ করলে পাওয়া যাবে ‘র্যাঙ্ক’। কেউ নতুন বিনিয়োগকারী আনতে পারলে তিনি সেই বিনিয়োগের ১০ শতাংশ পাবেন। আর ট্রেডিংয়ের মুনাফা থেকে পাওয়া যাবে আরও ১ থেকে ৫ শতাংশ। অ্যাকাউন্টে ১০ ডলার থাকলেই উত্তোলন করা যাবে টাকা। এ ছাড়াও আছে বৈশ্বিক মুনাফার অংশ থেকে শুরু করে বিদেশ ভ্রমণের মতো অন্তত ২০টি সুবিধা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এখান থেকে মুনাফা পাওয়ার ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছেন।

তবে হিলটনের বিপক্ষেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন অনেকে। সেসব পোস্টে পাওয়া যাচ্ছে ইলিয়াসের দাবির বিপরীত চিত্র। বিনিয়োগকারীরা জানাচ্ছেন, অর্থ উত্তোলনের জন্য সর্বনিম্ন ব্যালেন্স এরই মধ্যে ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ ডলার করা হয়েছে। তবে গত ৩ আগস্ট থেকে সেই অর্থও উত্তোলন করা যাচ্ছে না। মূলধন উঠিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও বন্ধ। নতুন বিনিয়োগকারী আনার বিনিময়ে কমিশনও পাওয়া যাচ্ছে না।

অবশ্য এর জবাবে হিলটনের এজেন্টরা বলছেন, সার্ভার উন্নত করার কাজ চলছে। এ কারণে আপাতত এসব সমস্যা হচ্ছে।

জিরো থেকে হিরো বানানোর প্রলোভন: দুবাইয়ে বসে ভিনদেশি অ্যালেক্স রেইনহার্টের সঙ্গে ‘আলটিমা টোকেন’ নামে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম চালান বাংলাদেশের মাহমুদুল হাসান। এখানে বিনিয়োগ করলে কমিশন, ক্যাশব্যাকের মতো লোভনীয় সব অফার দেওয়া হচ্ছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিটক গ্রুপে।

অন্যদিকে ২০ ডলার বিনিয়োগ করলে দৈনিক ৩৩ সেন্ট করে দেবে ট্রেস্ট এনটিএফই নামের আরেক প্রতিষ্ঠান। তবে ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে দিনে পাওয়া ১০০ ডলার। অন্য কারও কাছ থেকে বিনিয়োগ আনতে পারলে পাওয়া যাবে ১০ শতাংশ কমিশন। সেইসঙ্গে আছে জেনারেশন বোনাস, যা মূলত গতানুগতিক এমএলএম ব্যবসার ডান হাত-বাঁ হাত পদ্ধতি। এই প্ল্যাটফর্মে ডলারের জন্য টাকা জমা দেওয়া যায়। আর লাভের অর্থ উত্তোলন করা যাবে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে, এজেন্টদের হাতে ক্যাশে অথবা বাইন্যান্সের মাধ্যমে বিটকয়েনে।

ওয়েলাই ডট কম নামে আরেক প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করতে হয় কমপক্ষে ১০১ ডলার। তাহলেই উপহার পাওয়া যাবে ১৮ ডলার। নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত করতে পারলে পাওয়া যাবে ১০ শতাংশ কমিশন।

রেয়ানা মেটা এফএক্স এ বিনিয়োগ করতে হবে ন্যূনতম ৫০ ডলার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এই প্ল্যাটফর্মে ট্রেড হয় বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। রোবট সব কাজ করে তাই মুনাফার শতভাগ গ্যারান্টি দেয় রেয়ানা। কাউকে বিনিয়োগের জন্য নিয়ে এলে দেওয়া হয় ৫ শতাংশ কমিশন। প্রতিদিন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার মধ্যেই ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টে লাভের অর্থ চলে যায় বলে দাবি প্ল্যাটফর্মটির।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠানো হলেও কারও কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ন্যূনতম বিনিয়োগের পরিমাণ এবং কমিশনের হার আলাদা হলেও প্রায় একই রকম মডেলে চলে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের এসব প্ল্যাটফর্মে। বিপুল মুনাফার প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই এদের উদ্দেশ্য বলে মনে করেন সচেতন মহল। এ ধরনের ফাঁদে পা দিলে শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি প্রবল বলেও মত তাদের।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *