সাইদুর রহমান:
বর্তমানে আমাদের যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম হলো সড়ক পরিবহন। কিন্তু এই সড়ক পরিবহন এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। সড়কে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনায় বহু মানুষ আহত-নিহত হচ্ছেন। আহতদের একটি বড় অংশ পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। দেশে আধুনিক-নিরাপদ যানবাহন সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী না হওয়ার কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ ভাঙাচোরা বাস, ট্রাক, পিকআপ, হিউম্যান হলার, থ্রি-হুইলার, নসিমন, ভটভটি, আলমসাধু, টমটম, মাহিন্দ্র ইত্যাদি অনিরাপদ যানবাহনে যাতায়াত করছেন। এতে করে হরহামেশা মানুষ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া পায়ে হেঁটে পথ চলার সময় নিজেদের অসচেতনতা এবং যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে অনেক পথচারী আহত-নিহত হচ্ছেন। ইদানীং এটা বেড়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৮২ শতাংশই কর্মক্ষম মানুষ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছর এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্তরা তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে পরিবারের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে এবং দুর্ঘটনায় আহত সদস্যকে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে যেয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হচ্ছে। ফলে অসংখ্য পরিবার সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। চিকিৎসার পরেও যারা পঙ্গু হচ্ছেন তাদের অবস্থা আরও করুণ! মোটকথা, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থাসম্পন্ন পবিারগুলো আর্থিকভাবে টিকে থাকতে পারলেও নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলো পারছে না। এভাবেই দেশে আর্থ-সমাজিক সংকট তীব্র হচ্ছে। দেশে নানা ক্ষেত্রের চাকচিক্যের আড়ালে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ ক্ষত নিয়ে কত মানুষ যে যন্ত্রণাকাতর জীবনযাপন করছেন তার হিসাব নেই!
সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তীতে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় বহু মানুষের মৃত্যু কমানো সম্ভব, যদি আহত ব্যক্তিকে সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া যায়। চিকিৎসকদের মতে, দুর্ঘটনাপরবর্তী ছয় ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার। এই সময়ের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করতে পারলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার অনেকখানি কমানো সম্ভব। পঙ্গুত্ববরণও কমে। কিন্তু দুঃখজনক যে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের অধিকাংশকেই গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয় না প্রধানত দুটি কারণে- এক, পারিবারিক আর্থিক সংকট; দুই, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা না থাকা। জেলা সদর হাসপাতালে গুরুতর আহত রোগী নিয়ে গেলেই চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হওয়ায় তারা অর্থের অভাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক চিকিৎসা খরচ জোগাড় করে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে পারেন না। সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধার-দেনা করে ঢাকার আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হতে অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এছাড়া ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালে সিট না থাকা, আইসিইউ সুবিধা না পাওয়া ইত্যাদি কারণেও অনেক রোগী মারা যায়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা জরিপে দেখা যায়, দেশের পঙ্গু ভিক্ষুকদের ৮৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়া মানুষ। চক্ষু লজ্জার কারণে যারা এই পর্যায়ে আসেন না, তাদের দুর্ভোগ এসব ভিক্ষুকের চেয়ে কম নয়। এই যে মানব সম্পদের বিপুল অপচয়, জনশক্তির বিরাট ক্ষতি- এদিকে কারো নজর নেই। পূর্বের আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে সুযোগ-সুবিধা ছিল, তা কখনোই ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি। তারা জানতেই পারেননি তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা আছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অনিবার্য হয়ে উঠেছে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের চরম দুর্গতি।
যেহেতু পূর্বের আইনে থাকা তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বীমা সুবিধা পাননি, এই অজুহাতে বর্তমান আইনে মোটরযানের তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার বিধান উঠিয়ে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ‘ট্রাস্ট ফান্ড’- এর বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন হলেও ট্রাস্ট ফান্ড সম্পর্কিত বিধি তৈরি হয়েছে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। দীর্ঘদিন পর এই ট্রাস্ট ফান্ড আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে। যদিও এই ফান্ডের মাধ্যমে অদ্যাবধি কোনো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ক্ষতিপূরণ পাননি।
এই বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভিন্নতর ব্যবস্থা ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড’ গঠনের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। একটি দুর্ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে; ঢাকা থেকে বহুদূরের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতাল বা জেলা সদরের হাসপাতাল তাকে ঢাকায় রেফার্ড করে দিয়েছে। কিন্তু পরিবারটির হাতে কোনো টাকা নেই। টাকা জোগাড় করতে হলে ভিটে-বাড়ি বিক্রি করতে হবে। এই অবস্থায় সেই পরিবার কী করবে? কোথায় পাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াসহ চিকিৎসার আনুসঙ্গিক খরচ? এই বিষয়টি কি আমরা কখনো ভেবেছি? না ভাবিনি। কারণ আমরা নিজে বিপদগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের কষ্টকে জীবন দিয়ে অনুভব করি না। এই বোধটিই আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আহত ব্যক্তির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে অর্থের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমরা যদি সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ফ্রি করতে পারি, তাহলে এটাই হবে সবচেয়ে টেকসই ও মানবিক কাজ, যা সহজেই করা সম্ভব। এজন্য একটি সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করে সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ‘ট্রাস্ট ফান্ড’ বিলুপ্ত করে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড’ তৈরি করা যেতে পারে। এই ফান্ডে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৩ (তিন) হাজার কোটি টাকা হলেই দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইর চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সম্ভব। যেসব উৎস থেকে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ সংগ্রহ করা হবে; সেসব উৎসসহ পুলিশ কর্তৃক মোটরযান থেকে জরিমানার অর্থের একটি অংশ, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিএসআর ও অনুদান থেকে এই পরিমাণ অর্থ খুব সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব।
দুর্ঘটনাপরবর্তী ছয় ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার। এই সময়ের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করতে পারলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার অনেকখানি কমানো সম্ভব। পঙ্গুত্ববরণও কমে
এই ফান্ড গঠিত হলে- যে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিকটবর্তী বা প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে আহত ব্যক্তির পারিবারিক অর্থ ছাড়াই। এক্ষেত্রে রোগীর জন্য একটি মেডিকেল কোড নম্বর ব্যবহার করতে হবে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা খরচ রোগীর মেডিকেল কোডের বিপরীতে ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড থেকে গ্রহণ করবে। এই কার্যক্রম যথাযথ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী মাল্টি সেক্টরাল কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হবে। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি ইত্যাদির সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির সাংগঠনিক কাঠামো জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতে হবে। এসব কমিটিতে স্থানীয় সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, রোড সেফটি প্রফেশনাল, আইনজীবী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কমিটির সদস্য সংখ্যা অধিক হলে সহজে দুর্নীতি করা যায় না। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবার সহজে চিকিৎসাসেবা এবং ক্ষতিপূরণ পাবেন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সবাই জেলা সদর হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিউরো সার্জারি বিভাগ উন্নত করতে হবে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় হেড ইনজুরি বেশি হয় এবং হেড ইনজুরির কারণেই অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এসব বিবেচনায় বর্তমান সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ট্রাস্ট ফান্ডের পরিবর্তে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড’ গঠন করা জরুরি। একই সঙ্গে মোটরযানে ‘তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা’ প্রবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বীমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এই বীমাব্যবস্থা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই আছে। কার্যকর টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করে যেকোনো মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে ফান্ডের প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি মানুষের দুর্দশাও কমবে। যেহেতু সড়ক পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তাই এসব দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। উল্লিখিত ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ডকে জনবান্ধব করার জন্য এর গঠন কাঠামো এবং পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই এটার প্রয়োজনীয়তাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার অভিঘাতে সাধারণ মানুষ খুব কষ্টে আছে।
[লেখক: নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন]
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত