ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা :সিরাজগঞ্জের তাড়াশে গ্রীষ্মের শুরুতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেশিরভাগ নলকূপে পানি ঠিকমতো উঠছে না। এতে মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পড়ার পাশাপাশি চলতি বোরো আবাদে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। একই অবস্থা রাজবাড়ী, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অনেক টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। খাবারের পানিসহ নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মানুষকে। পানির অভাবে সেচ সংকটে কৃষিপণ্য উৎপাদনেও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
পানি বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দখল-দূষণে নদী, খাল, বিল ধ্বংস করা ও পানির অপব্যবহারের কারণে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে আশঙ্কাজনক হারে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামার কারণে কমছে সুপেয় পানির উৎস। কৃষি ও শিল্প খাত সংকটে পড়ার পাশাপাশি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বাড়ছে।
দূষণ ও দখলের কারণে রাজধানীর চারপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ঢাকা নগরীর বাসাবাড়ি এবং শিল্প-কারখানায় যে পানি ব্যবহার করা হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশই উত্তোলন করতে হয় মাটির নিচ থেকে। প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পানি আইন লঙ্ঘন করে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পানির স্তর দ্রুততার সঙ্গে নেমে যাচ্ছে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। তাই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সহনীয় পর্যায়ে আনতে না পারলে কয়েক দশকের মধ্যেই সুপেয় পানির সংকট তৈরিসহ বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গায় পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। তা ছাড়া দূষণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে দেশে বিশুদ্ধ পানির যেসব উৎস রয়েছে সেগুলোও আস্তে আস্তে দূষিত হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পানির এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেও সুপেয় পানির রিজার্ভে হুমকি বাড়ছে। তাই পানি আইন মেনে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা না হলে এ সংকট বাড়তেই থাকবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ২ মিটার করে নেমে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালে ঢাকা শহরে ৬ মিটার মাটির নিচেই পানি পাওয়া যেত। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটারে, ২০১০ সালে ৬০ মিটারে এবং ২০২৪ সালে এসে ৭৫ মিটারে নেমেছে। ঢাকার ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াসার ১ হাজার পাম্প ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপন করা অন্তত ২ হাজার গভীর নলকূপ দিয়ে প্রতিদিন ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হচ্ছে। শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। ওয়াসার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫ সালে ঢাকায় প্রতিদিন ৩৫ লাখ ঘনমিটার, ২০৩০ সালে প্রতিদিন ৪৩ লাখ ঘনমিটার এবং ২০৩৫ সালে প্রতিদিন ৫২ লাখ ঘনমিটার পানির চাহিদা থাকবে। ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে পানির স্তর নেমে যেতে পারে ১২০ মিটারে। ২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা হতো। আর ২০ শতাংশ ছিল ভূ-উপরিভাগের পানি। সংস্থাটি ২০২৫ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিভাগ থেকে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও এখনও এ হার মাত্র ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমানে ওয়াসার দৈনিক উৎপাদিত পানির ৭০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎসের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান পরিদফতরের পরিচালক (জিওলজি) ড. আনোয়ার জাহিদ জানান, অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্রমাগত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার আদর্শ নিয়ম হলো, পানি উত্তোলনের পরিমাণ কখনোই রিচার্জের পানির চেয়ে বেশি হতে পারবে না। কিন্তু মানুষ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে যে পানি তুলে ফেলতে পারে তা প্রাকৃতিকভাবে পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। রাজধানীতে ভবন বৃদ্ধি ও কংক্রিটের অবকাঠামো বাড়তে থাকা এবং ক্রমশ জলাশয় বিলুপ্তি হতে থাকায় ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিকভাবে পুনরায় ভরার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমছে। জলাশয়গুলো দখল, ভরাট ও দূষিত করে ফেলা হচ্ছে। যে হারে পানি তোলা হচ্ছে সে হারে পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির সংকট শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নদী-নালা শুকিয়ে যাবে। দেশ পুরো মরুকরণের দিকে চলে যাবে। কোনো এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি না থাকা মানে সেই এলাকাটাই ধ্বংস হয়ে যাওয়া। শরীফ জামিল বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট হতে না দেওয়া এবং নদী দখলমুক্ত করা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, শহরের মধ্যে খাল বা অন্য জলাশয়গুলো হচ্ছে শহরের একটি সৌন্দর্য। এগুলো শহরের পরিবেশকে পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে সেটি আমরা অনুভব করতে পারিনি এবং সরকারও এটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। বিআইপিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার বলার পর সিটি করপোরেশন এটি এখন অনুভব করছে। তারা ঢাকা শহরের ভেতরের চারটি খাল উদ্ধারের জন্য প্রকল্প নিচ্ছে। তিনি জানান, বিআইপির পক্ষ থেকে ১১টি খাল উদ্ধারের জন্য পদক্ষেপ নিতে দুই সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে আগেই। এ ছাড়া ঢাকা শহরের মধ্যে যেসব ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাধার রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণেও সরকারিভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সহনীয় পর্যায়ে আনার তাগিদ দিয়ে ফজলে রেজা সুমন বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। তাই সরকারকে জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, রাজধানীতে যেসব জলাধার বর্তমানে আছে এটি কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে দখল হয়ে যাওয়া খাল ও জলাধারগুলো যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই উদ্ধারের উদাহরণ রয়েছে। যেমন কোরিয়ার সিউলে একসময় খাল ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। কোথাও কোথাও বক্স কালভার্ট করা হয়েছিল। এখন কিন্তু সেগুলো ভেঙে খাল উদ্ধারের পর দুই পাড় বাঁধাই করে পার্কের মতো তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং চাইলে ঢাকায়ও এটি সম্ভব।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকায় পানির জলাধারগুলো ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। তাই রাজধানীতে পানির উৎস বাড়ানোর লক্ষ্যে খালগুলো সংস্কার ও অবৈধ দখলমুক্ত করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। দেশে ৯৮ শতাংশ অঞ্চল পানি সরবরাহের আওতায় রয়েছে। ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে যেখানে সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব, তা করা হচ্ছে। গ্রামেও সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ সার্ফেস ওয়াটার শিফট করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ চলছে। রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ছাড়াও সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে অনতিবিলম্বে গ্রামের মানুষও সুপেয় পানি পাবে বলে জানান তিনি।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত