মহসীন হাবিব: ঘুষ-দুর্নীতি তথা অসদুপায়ে অর্থ আয় সম্ভবত রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরুর পর থেকেই আছে। মহাজ্ঞানী চানক্য প্রায় ২২শ বছর আগে লিখেছেন, ‘জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেখে দেখা যেমন অবাস্তব, তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুও সে সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিচরণ করা মাছ কখন জল পান করে তা বোঝা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সরকারের নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তহবিল তছরুপ চিহ্নিত করাও পুরোপুরি সম্ভব নয়।’ স্টিফেন হ্যাচ বার্নওয়েল ছিলেন আইসিএস অফিসার। তিনি ভারত বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানেরই সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে থেকে যান। তিনি একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ লিখেছেন ‘দ্য লাস্ট গার্ডিয়ান’ নামে। বইটি ইউপিএল প্রকাশ করেছিল। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, কোনো একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা লন্ডনে একটি রিপোর্ট পাঠান, সেই রিপোর্টে লেখেন, ‘ঘুষ ইজ অ্যা ডেলিসিয়াস ফুড ইন দ্য সাব-কন্টিনেন্ট’। অর্থাৎ ঘুষ এখানে একটি উপাদেয় খাবার! তিনি দক্ষিণ দিনাজপুরের এসডিও থাকতে একবার এক বয়স্ক নারী একটি ঘটভরা স্বর্ণ এবং স্বর্ণমুদ্রা পেলেন মাটি খুঁড়তে গিয়ে। পুলিশের স্থানীয় কর্মকর্তা সেই মূল্যবান সম্পদের সন্ধান পেলেন। ব্যস, উধাও হয়ে গেল। পরে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, তারই এক পরিচিতজনের কাছে বিক্রয় করা হয়েছে ওই স্বর্ণ।
এই সমাজ ব্যবস্থায় অল্পস্বল্প ঘুষ খাওয়াকে খুব একটা দোষণীয় বলতে পারি না। সরকার যে বেতন দেয় তা দিয়ে একটু ভালো থাকা, একটি নিশ্চিন্তে থাকা হয়ে ওঠে না (যদিও এখন এ কথা পুরোপুরি সত্য নয়। যা বেতন ভাতা পাওয়া যায়, তা দিয়ে ভদ্রোচিত জীবনযাপন সম্ভব)। ঘুষ-দুর্নীতি পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতির দেশেও আছে। বিশেষ করে কর ফাঁকি পশ্চিমা দেশে প্রায় ওপেন সিক্রেট। শ্রদ্ধেয় আকবর আলি খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’তে লিখেছেন, “ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো বৈরিতা নেই। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, দুর্নীতির পক্ষেই বিকশিত হয়েছে পুঁজিবাদের শতদল। ইউরোপে অনেক পুঁজিপতিই জীবন শুরু করেন একচেটিয়া ব্যবসায়ের লাইসেন্সের এবং কর ইজারার মতো সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার করে।” কিন্তু বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে তাকে এসব ঘুষ দুর্নীতির সীমানার মধ্যে ফেলা যায় না। দুর্নীতি, রাহাজানি, লুটপাটের সব সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে মাত্র কয়েকশ মানুষ। দুর্নীতির পরিমাণ এত যে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের সম্পদের পরিমাণ গোটা দেশবাসীকে চমকে দিয়েছে। এতদিন তা গোপন থাকলেও এখন থলের বিড়াল বের হয়ে এসেছে। আরও অনেক নাম মানুষের মুখে মুখে এবং এর সঙ্গে আমরা এমন কিছু ভয়ানক চিত্র দেখতে পাচ্ছি, যা মধ্যযুগেও সম্ভব ছিল না। বেনজীর আহমেদ একজন সুদর্শন পুরুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অনেকের কাছে তার স্মার্টনেসের গল্প শুনেছি। পুলিশের আইজি থাকতে যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার বক্তব্য শুনেছি, তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছি। কিছু ভালো কাজও তিনি করেছিলেন। তাই বলে তার প্রতিদান এভাবে? এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষ নাকি তার ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করে। বেনজীর সে কথা ভালো করে প্রমাণ করলেন।
কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। এমন একজন শিক্ষিত মানুষ কি একবারও ভাবেননি যে কেন তিনি এত সম্পদ গড়ে তুলছেন? আজ হোক বা কাল তার এ সম্পদের খবর লুকিয়ে রাখা যাবে না? কীইবা করবেন তিনি এত সম্পদ দিয়ে? সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শিশুর দাঁত উঠলে কামড়াতে চায়। ছাগলের কচি শিং উঠলে গুঁতোতে চায়। শিং যত পাকা হয়, বুদ্ধি যত ঝানু হয়, তখনই সে বুঝতে পারে—যতই শিং সুরসুর করুক, সব জায়গায় ঢুঁ মেরো না। ঢুঁর কাউন্টার ঢুঁ সামলাতে পারবে কি না, ভেবে দেখো।’ না, আমাদের ধারণা ভুল। বেনজীর আহমেদ ঠিকই জানতেন যে পার পাওয়ার রাস্তা আছে! এখন শোনা যাচ্ছে তিনি দিব্যি দেশ ছেড়ে দুবাই-সিঙ্গাপুর-তুরস্ক এমন কোথায় চলে গিয়েছেন। অথচ দেড় মাস আগে থেকেই দুদক আদালত তার বিরুদ্ধে সোচ্চার! দেশের পত্রপত্রিকায় বেশ কিছুদিন ধরে তার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে শিরোনাম প্রকাশ হচ্ছে। কারা পার করল তাকে? এর আগে আমরা দেখেছি পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে গেলেন। তিনি সীমান্ত পার হয়ে যাওয়ার ১৩ মিনিট পর তার বিরুদ্ধে সীমান্তে নোটিশ গেল! এর মানে কী? কাউকে এর জন্য কোনো জবাব দিতে হয়েছে? এই অদৃশ্য নেটওয়ার্কের কর্মের ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নেটওয়ার্কটি সক্রিয় শক্তি থেকে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। চোখের আড়ালে কি? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে। যাদের জানার কথা তারা ঠিকই জানেন, চেনেন। জনগণের স্বার্থের চেয়ে বড় আর কোনো স্বার্থ কি থাকতে পারে? আসলে দীর্ঘকালের দুর্বল শাসন ও শক্তিধরদের দাপটের কাছে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে গিয়েছে। সমাজে যখন সুযোগসন্ধানীর সংখ্যা বেড়ে যায় তখন প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। সত্যিকারের প্রতিবাদীর সংখ্যা এখন বাংলাদেশে প্রায় শূন্য। যারা সরকারবিরোধী আন্দোলন করে, তারাও নির্দিষ্ট এজেন্ডার বাইরে যায় না। একমাত্র লক্ষ্য ‘সিংহাসন’ হলে যা হয়! সমাজে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবী যাদের মুখ খোলার কথা তারা নানাভাবে বিভাজিত। অন্যায়ের প্রতিবাদের সুরের মধ্যেই থাকে অন্য একটি দলকে সমর্থনের সুর। এক চরম বিশ্রী অবস্থা। সেদিন একজন সিনিয়র অর্থনীতিবিদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের আবারও অর্থচুরির একটি খবর ভারতীয় একটি পত্রিকা ছেপেছে। তা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? তিনি ম্যাড়ম্যাড় করে বললেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সত্য হোক বা মিথ্যা, যেটা আপনার মনে হয় আপনি সেটাই বলুন, বলতে পারবেন না কেন! এই যে মালয়েশিয়ায় চাকরির আশায় যেতে চাওয়া অসহায় হাজার হাজার মানুষের যাত্রানাস্তি হলো, এখন পর্যন্ত দেখেছেন কাউকে অভিযুক্ত করে আইনের আওতায় আনতে? যে মানুষটির ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা, সে জমিজাতি বিক্রি করে ৪-৫ লাখ টাকা দিয়ে এখন রাস্তায়! ইনফরমাল দেশে সবকিছু সম্ভব। অথচ কেউ দায় নিচ্ছে না। এক সময় এয়ারপোর্টে যারা কেঁদেছেন চরম ভোগান্তিতে পড়ে, তাদের অর্থের কথাই আজ আমরা গর্বের সঙ্গে বলি রেমিট্যান্স। আমাদের লজ্জা থাকা উচিত। সত্যিই আজ মনে হচ্ছে কোথাও কেউ নেই। অনেক কথা এক ছোট্ট নিবন্ধে বলা যায় না। দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিশাল বাহিনীর কাহিনি তৈরি রয়েছে। তারা কেউ অচেনা নন। দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে অ্যাসেট ইনকোয়ারি নামে একটি তামাশা চলে। কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? অবলোপনকৃত ঋণ, ঋণখেলাপি এসব বাদই থাক। আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি থেকে খানিকটা উল্লেখ করে শেষ করি, “দুর্নীতি যদি সমাজের কয়েকটি খাতে সীমাবদ্ধ থাকে তবে তা দমন করা সহজ; কিন্তু দুর্নীতি মুষ্টিমেয় লোকের বিচ্যুতি নয়, দুর্নীতি সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি একটি সামগ্রিক কাঠামোগত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের সমাজে দুর্নীতি নিরন্তর প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এক ধরনের দুর্নীতি আরেক ধরনের দুর্নীতির জন্ম দেয়, এক খাত হতে দুর্নীতি আরেক খাতে সংক্রমিত হয়। এই পরিস্থিতিতে আইন সমাজের পরাক্রমশালীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”
বাংলাদেশের চিত্র এখন ঠিক তাই। সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বিমানচালক, মুদিদোকানদার থেকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব, রাজনৈতিক দলের থানা কমিটির থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটি সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে ডেলিসিয়াস ফুড—ঘুষ। এই অবস্থা পরিবর্তনে প্রয়োজন এখন বিশেষ কিছু করা। এক সময় ঠগিদের, অর্থাৎ ডাকাত ও দলবদ্ধ ছিনতাইকারীর অত্যাচারে বাংলায় ও দাক্ষিণাত্যে ভয়ানক অবস্থা তৈরি হয়। প্রায় ৪০০ বছর ঠগিরা অবাধে জনগণের ওপর অত্যাচার করে। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক ‘ঠগি অ্যান্ড ডেকয়েটি ডিপার্টমেন্ট’ তৈরি করেন এবং তার দায়িত্ব দেন সৎ চৌকষ বেঙ্গল আর্মির প্রাক্তন অফিসার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানকে। এই স্লিম্যান বর্তমান ভারতের মধ্যপ্রদেশে গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি থাকাকালে এশিয়ার প্রাচীনতম ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন। স্লিম্যান অচিরেই বিশাল এলাকা থেকে ঠগিদের চিরতরে বিতাড়ন করেন। প্রায় ১ হাজার ৪০০ ঠগিকে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলান এবং কাউকে দ্বীপান্তরিত করেন। বাংলার ও দাক্ষিণাত্যের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে দীর্ঘকাল পর শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে। ১৯৩০-৪০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটলে উদ্ভব হয় এডগার হুবারের (যিনি এফবিআই প্রতিষ্ঠা করেছেন)। কঠোর হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার জন্য সরকারের মানসিক শক্তি আছে কি না?
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত