বদলে যাচ্ছে ফ্রান্সের রাজনৈতিক সমীকরণ


রায়হান আহমেদ তপাদার: রক্ষণশীল অনুগত বনাম মধ্যপন্থি বিদ্রোহী পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে-পরে দুই সময়ই নিজ নেতৃত্ব নিয়ে নজিরবিহীন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। নির্বাচনে দলের জয় নিয়ে শঙ্কায় থাকা প্রার্থীরা প্রকাশ্যে তাকে এড়িয়ে চলেছেন। অন্যদিকে সরকারে থাকা প্রধানমন্ত্রী আতালের মতো প্রভাবশালী নেতারা মাখোঁর আগাম নির্বাচন আহ্বানের সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন। বামপন্থি দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। উগ্র ডানপন্থি দল ন্যাশনাল র্যালির (আরএস) ভূমিধস বিজয় তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে। সোশ্যালিস্ট, গ্রিনস, কমিউনিস্টস ও জ্যঁ লুক মেলেনচনের ফ্রান্স আনবোড দলের মধ্যে অতীতে গভীর বিভক্তি ছিল। সেই বিভক্তি মিটিয়ে একটি জোট করা সহজ ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থি জোটের বিজয় ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম বলতে চেয়েছে, অতি ডান ও বাম দুই শিবিরই রাজনৈতিকভাবে খুব কাছাকাছি। মেরি লো পেন এবং ন্যাশনাল র্যালি পার্টির প্রেসিডেন্ট জরদান বারদেলা গত মাসের নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের দলকে নতুন মধ্যডানপন্থি দল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। বামপন্থি জোটকে বিশেষ করে জ্যঁ লুক মেলেনচনকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে অ্যান্টিসেমেটিক তকমা দেন তারা। মধ্যপন্থি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কিছু ডানঘেঁষা কর্র্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে মধ্যপন্থা ও ডানপন্থার মধ্যকার ভেদরেখাটা হাপিশ করে দিয়েছিলেন। ফলে মূলধারার দল হিসেবে পার্লামেন্টে ন্যাশনাল র্যালির পুনর্বাসনের শর্ত প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, ডানপন্থি দল অবশেষে ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে। জরিপে আরএনের পরিষ্কার বিজয়ের পূর্বাভাস সত্ত্বেও ফ্রান্সের ভোটাররা লো পেনের কট্টর ডানপন্থি আরএনকে প্রত্যাখ্যান করেন। এনএফপি জোট ১৮২টি আসন পেয়ে প্রথম হয়। মাখোঁর মধ্যপন্থি ও নয়া উদারবাদীদের জোট ১৬৩টি পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। লো পেন ও বরদেলার আরএন পেয়েছে ১৪৩টি আসন। তাদের সামনে সরকার গঠনের কোনো বাস্তব পথ নেই। মেলেনচন ও তার নতুন মিত্ররা ফ্রান্স জুড়ে যে বিজয় পেয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে স্মরণীয়। তারা দেখিয়েছেন, বামদের এবং অর্থপূর্ণ সংস্কার ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রশ্নে তাদের দাবির বিজয় হয়েছে। তারা আরও দেখিয়েছেন, মধ্যপন্থিদের নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত উগ্র ডানপন্থিদের যে উত্থান তৈরি করেছিল, তার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে বামপন্থিদের এজেন্ডা।
এর মানে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে যাচ্ছে। এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোয় আরএন আরও শক্তি নিয়ে লড়াই করবে। তা সত্ত্বেও বামজোট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও হারানো সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে। অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে মাখোঁও ব্যর্থ হয়েছেন। তার কর্র্তৃত্ববাদী নীতি উগ্র ডানপন্থাকে স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত করেছে। ফলে ফ্রান্সের অনেক ভোটার আরএনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভোটাররা আরএনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটা ফ্রান্সের পথ তৈরির সুযোগ তাদের সামনে এসেছে। এনএফপি জোট যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, অবসরের সময় ৬৪ বছর থেকে কমিয়ে ৬০ করা, ৫ বছরের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ১০ লাখ গৃহনির্মাণ এবং খাদ্য, জ্বালানি ও গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা। জোটটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিশুদের সব শিক্ষাব্যয় রাষ্ট্র নির্বাহ করবে। আর এ ব্যয়ভার নির্বাহ করা হবে ধনীদের ওপর কর বসিয়ে। এসব এজেন্ডার বাস্তবায়ন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। তারা অতি ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি পাল্টা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
আতাল এ বছরের শুরুতে নিয়োগ পান এবং দলের প্রচারে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে অনেক সফর করেন। কিন্তু পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া নিয়ে নির্বাচনের রাতে মাখোঁর অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন আতাল। বলেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয়নি। সরকারপ্রধান আতালের এমন লড়াকু মনোভাব তাকে দলের অন্য প্রতিবাদী আইনপ্রণেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। ফ্রান্স আনবোড দলের নেতা জ্যঁ-লিখ মিলোশো বলেছেন, এনএফপি জোট থেকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাই করা উচিত। যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে জোটের দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপসহ কয়েকজন মধ্যপন্থি নেতা বলেছেন, স্থিতিশীল সরকার গড়ে তুলতে একটি চুক্তির ব্যাপারে কাজ করার জন্য তারা প্রস্তুত। ফ্রান্সের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন, তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তবে নতুন সরকার গঠন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের কথা মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তা এখনই গ্রহণ করবেন কি না, তা অনিশ্চিত।
ফ্রান্সের সংবিধান অনুসারে, ১২ মাসের মধ্যে মাখোঁ নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন না। মাখোঁ চাইবেন, বামপন্থি জোট থেকে সোশ্যালিস্ট ও গ্রিনসরা ঝরে যাক। এতে একা হয়ে পড়া ফ্রান্স আনবোডের সঙ্গে মিলে মধ্য-বামপন্থি জোট গঠন করবেন। যদিও এখন পর্যন্ত নিউ পপুলার ফ্রন্টের মধ্যে ভাঙনের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে বামপন্থি সমর্থকদের ব্যাপক বিজয়োল্লাস করতে দেখা গেছে। ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বামপন্থি জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) জয়ী হলেও তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এমন অবস্থায় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এনএফপির সামনে দুটি পথ খোলা। এনএফপিকে হয় কমসংখ্যক আসন নিয়েই সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে কাজ করতে হবে। না হলে কমসংখ্যক আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে না চাইলে অন্য কাউকে নিজেদের জোটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তবে ইউরোপের দেশ জার্মানি কিংবা নরওয়ের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর জোট করে সরকার গঠনের ঘটনা পরিচিত হলেও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। সুতরাং বলাই যায়, ফ্রান্সের নতুন পথ তৈরির সুযোগ হয়তো এসে গেছে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়