ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নিরাপত্তা হেফাজতে না আটক!

কার্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’র কথা বলে কয়েকদিন আগে তুলে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে আরও দুই সমন্বয়ক ও এক শিক্ষককে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। তারা হলেন-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব।

পুলিশের পক্ষ থেকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’র কথা বলা হলেও আইনে এ ধরনের কিছুই নেই বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। তারা বলছেন, কারও নিরাপত্তা দরকার হলে আদালতের কাছে প্রার্থনা করবেন, যা কোটা আন্দোলনকারীরা করেননি। এছাড়া কোনো অপরাধে আটক করা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়, যা ডিবি করেনি। এটিকেও আইনের লঙ্ঘন বলছেন তারা।

অন্যদিকে ডিবি হেফাজতে সমন্বয়কদের নির্যাতন করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ নাহার। তারা নাহিদের সঙ্গে দেখা করতে ডিবি কার্যালয়ে গেলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আন্দোলনকারীরা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পরই তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা হবে। অন্যদিকে সমন্বয়কদের নিরাপত্তার জন্য আনা হলেও আন্দোলনের নানা বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থনসহ গ্রেফতারদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা।

জানা যায়, শনিবার সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় ডিবি। এর আগে শুক্রবার অপর তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নাহিদ ইসলামকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটক করে ডিবি। তাদেরও নিরাপত্তাজনিত কারণেই আটক করা হয় বলে জানানো হয়। এছাড়া নতুন করে নুসরাত, আরিফ ও শিক্ষক আসিফকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেন স্বজনরা। এর মধ্যে নুসরাত ও শিক্ষক আসিফকে তুলে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে দুজনকে রোববার সকালের দিকে আনার কথা জানিয়েছে ডিবি। আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, নিরাপত্তা হেফাজত বলে আইনে কিছুই নেই। হয় তাদের গ্রেফতার দেখাতে হবে, না হয় তাদের ছেড়ে দিতে হবে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, পুলিশ নিজেদের অপরাধ ঢাকতে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়ার কথা বলছে। এ ধরনের আটক পুরোপুরি বেআইনি।

সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ  বলেন, কাউকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিতে হলে আদালতের নির্দেশে নিতে হবে। এর জন্য আলাদা ভবন ও আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। পুলিশ কাউকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিতে পারে না। তারা কাউকে আটক করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, নিরাপত্তা হেফাজত ঠুনকো অজুহাত। শিক্ষার্থীদের আটক করে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে।

আরিফ ও নুসরাতকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ : ঢাবি শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি পরিচয়ে রোববার ভোর ৫টায় মিরপুরের একটি বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় বলে অন্য সমন্বয়ক ও স্বজনরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে আরিফ সোহেলকে শনিবার রাত পৌনে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন আমবাগান এলাকার ভাড়া বাসা থেকে ডিবি ও সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পরিবার।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ও নুসরাত তাবাসসুমকে ভোরে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। অবিলম্বে তাদের সন্ধান ও মুক্তি চাই। তিনি বলেন, আমাদের একের পর এক সমন্বয়ককে আটক করা হচ্ছে। আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং আতঙ্কিত।

আরিফ সোহেলের বাবা আবুল খায়ের জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসার নিচে ৮-১০ জন এসে দরজায় ধাক্কা দেন। তারা নিজেদের ডিবি ও সিআইডির লোক বলে পরিচয় দেন। দরজা খুলে দিলে তারা বাসার দ্বিতীয়তলায় এসে প্রথমে সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। তারা জুয়েলের কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড নিয়ে কম্পিউটারের বিভিন্ন ড্রাইভ চেক করে বেশ কয়েকটি ছবি তোলেন। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরিফ সোহেল ও জুয়েলের সঙ্গে কথা বলবেন জানিয়ে তৈরি হতে বলেন। জুয়েলকে কেন যেতে হবে জানতে চাইলে তারা আন্দোলনসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য যেতে হবে বলে জানান। পরে আরিফ ও জুয়েল তাদের সঙ্গে বের হন। তিনিও ছেলেদের সঙ্গে যেতে চেয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ালে তাকে উঠতে বলা হয়। তিনি গাড়ির সামনে থেকে সরে উঠতে গেলে গাড়িটি দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। পরে বিভিন্ন থানা ও সাভারে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি (উত্তর) কার্যালয়ে গিয়ে সন্তানদের খোঁজ পাননি। একপর্যায়ে বড় ছেলে জুয়েলের মোবাইল ফোনে কল করলে জানতে পারেন, তারা তাকে কিছুদূর নিয়ে নামিয়ে দিয়ে শুধু আরিফকে নিয়ে গেছে।

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএফএম সায়েদ বলেন, জাবি শাখার কোনো সমন্বয়ককে এই থানায় আনা হয়নি। ঢাকা জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবির (উত্তর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডিবি পরিচয়ে রাতে কাউকে তুলে আনার বিষয়টি আমার জানা নেই।

ব্র্যাকের সাবেক শিক্ষক আসিফের খোঁজে বাবা-মা : রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি পুলিশ কার্যালয়ের সামনে রোববার অপেক্ষায় ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের বাবা-মা। তারা বলেন, শনিবার রাত ১টার দিকে আসিফ মাহতাবকে উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ১০/এ সড়কের বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সকালেই তারা দুজনে মিন্টো রোডে ডিবি অফিসে ছেলের খোঁজে আসেন। ছেলের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছেন না তারা। পাঠ্যবইয়ের শরীফ থেকে শরীফা গল্পের পাতা ছিঁড়ে আলোচনা-সমালোচনায় আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক।

ডিবি অফিসে কিসের নিরাপত্তা-সমন্বয়ক নাহিদের মায়ের প্রশ্ন : সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ডিবি হেফাজতে নির্যাতন করা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার মা মমতাজ বেগম। রোববার বিকাল সাড়ে ৪টায় নাহিদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মা মমতাজ বেগম, দুই ফুপু, এক খালা ও তার স্ত্রী। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে নাহিদের পরিবার ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নাহিদের মা মমতাজ বেগম বলেন, আমরা নাহিদের সঙ্গে দেখা করতে ডিবি কার্যালয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের মিন্টো রোডে প্রবেশ করতে দেয়নি। নাহিদের স্ত্রী ও খালা পুলিশের সঙ্গে কথা বললে তাদের জানায়, ভেতরে যাওয়া যাবে না। মমতাজ বেগম বলেন, ডিবি বলছে নিরাপত্তার কারণে তাদের কাছে রেখেছে। সন্তান মা-বাবার কাছে নিরাপদ। ডিবি অফিসে কিসের নিরাপত্তা?

শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাবি ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের : কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন ও গ্রেফতারদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা। রোববার বিকাল সোয়া ৩টায় বিভাগের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক জেরিন আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।

আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তায় হেফাজতে নেওয়া হয়েছে-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ছিল, সেটি তারা জানিয়েছিলেন। এ কারণে তাদের নিরাপত্তার জন্যই হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পরই তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা হবে।

আন্দোলন নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে-হারুন : নিরাপত্তার স্বার্থে পাঁচ সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। রোববার দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ডিবি প্রধান বলেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লাগিয়েছে। কেউ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তারা যদি বিভিন্ন জায়গায় বলে, তাদের সঙ্গে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হতে পারে, এটা জানার পর আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের নিরাপদে নিয়ে আসা। তাদের কতদিন হেফাজতে রাখা হবে, সেটি সমন্বয়কদের সঙ্গে এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানানো হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশীদ বলেন, যেহেতু তারা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের কাছে, তারপরও তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। আন্দোলনের সময় তাদের সঙ্গে কারা কারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, কারা কারা তাদের উসকানি দিয়েছিল। আমরা তাদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা কিছু নাম ও নম্বর আমাদের দিয়েছে।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *