হানিয়ার জানাজা পড়ালেন খামেনি, কাতারে দাফন


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং তার নিরাপত্তা রক্ষীর জানাজা নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এ জানাজা পড়ান ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাইয়েদ আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।
জানাজায় উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া ও ওয়াসিম আবু শাবান নামে তার দেহরক্ষীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। নিহত হামাস কর্মকর্তার শোক মিছিলে বিপুল সংখ্যক ইরানি জনতা অংশ নেন।এর আগে, বুধবার ভোরে এক সন্ত্রাসী হামলায় তেহরানে নিজের বাসভবনে দেহরক্ষীসহ নিহত হন হানিয়া।
মঙ্গলবার ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই ইরানের রাজধানীতে ছিলেন হানিয়া। সেখানে তিনি প্রতিরোধ ফ্রন্টের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।হামাস প্রধানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত খবর এখনও জানা যায়নি। তবে প্রাথমিক তদন্তে ইসরাইলি শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে এবং জো বাইডেন প্রশাসনের সবুজ সংকেতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান।
হানিয়াকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে: সৌদি আরব
হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ইরানের তেহরানে তার ব্যক্তিগত বাসভবনে ‘গাইডেড মিসাইল’ ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যম আল হাদাথের কয়েকটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।আল হাদাথের প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার তেহরানের স্থানীয় সময় রাত ১১টা ৩০ মিনিটে হানিয়ার বাসভবনে ক্ষেপণাস্ত্রের ওই হামলা চালানো হয়েছে।হানিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরেও প্রায় একই রকমের তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফার্স নিউজ বলেছে, উত্তর তেহরানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ করা বাসভবনে অবস্থান করছিলেন হানিয়া। এ সময় ‘আকাশ থেকে ছোড়া অস্ত্রে’ তাকে হত্যা করা হয়েছে।বুধবার সকালে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ইসমাইল হানিয়ার নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে।
খবরে বলা হয়, রাজধানী তেহরানে এক হামলায় হানিয়া ও তার এক দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীও হামাসের শীর্ষ নেতার নিহত হওয়ার খবর জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
ইসরায়েলে হামলার নির্দেশ খামেনির
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। ইরানের রাজধানী তেহরানে আবাসস্থলে হওয়া হামলায় হানিয়ার এক দেহরক্ষীও নিহত হয়েছেন।এই ঘটনায় প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। এমনকি হানিয়া হত্যার জবাবে তিনি সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস।
ইরানি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে স্থানীয় সময় বুধবার (৩১ জুলাই) এই তথ্য জানায় মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমটি। এছাড়া এনওয়াইটি’র এই প্রতিবেদন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলও।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার জবাব হিসেবে ইসরায়েলের ওপর সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন বলে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে। তিনজন অজ্ঞাতনামা ইরানি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি এই তথ্য সামনে এনেছে।ওই তিন কর্মকর্তার মধ্যে দুইজন রেভোলিউশনারি গার্ড সদস্য রয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হানিয়া হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, হামাস প্রধান হানিয়া নিহত হয়েছেন বলে ইরান ঘোষণা দেওয়ার পরপরই খামেনি বুধবার সকালে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকে এই আদেশ দেন বলে জানিয়েছেন রেভল্যুশনারি গার্ডের দুই সদস্যসহ তিনজন ইরানি কর্মকর্তা। তারা তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি, কারণ এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার জন্য তারা অনুমোদিত কেউ নয়।
ইরান ও হামাস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করেছে। টানা প্রায় ১০ মাস ধরে গাজা উপত্যকায় হামাসের সাথে যুদ্ধ করছে ইসরায়েল। ইহুদিবাদী এই দেশটি অবশ্য ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য তেহরানে যাওয়া হানিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি। যদিও ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সামরিক কমান্ডারসহ বিদেশে ‘শত্রুদের’ হত্যা করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের।
গাজায় প্রায় ১০ মাসের চলমান এই ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময়ে ইরান অনেকটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে। দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে এই অঞ্চলে তেহরানের মিত্র এবং প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে তীব্রভাবে আক্রমণ বাড়ানোর মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে ইরান।
অবশ্য ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে শত্রুতার সম্পর্ক বজায় রয়েছে এবং গত কয়েক দশকের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিলে ইসরায়েলের ওপর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে স্পষ্ট আক্রমণ চালায় ইরান। সিরিয়ার দামেস্কে বেশ কয়েকজন ইরানি সামরিক কমান্ডারকে হত্যার পাশাপাশি দূতাবাস প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করে ওই হামলা চালিয়েছিল তেহরান।
আর এবার হানিয়া হত্যার জেরে সরাসরি ইসরায়েলে হামলার নির্দেশ দেওয়ার পর ইরানি কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘এখন এটা স্পষ্ট নয়, ইরান ঠিক কতটা শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং দেশটি (গত এপ্রিলের মতো) আবারও তার আক্রমণকে আরও ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য ক্যালিব্রেট করবে কিনা। ইরানের সামরিক কমান্ডাররা তেল আবিব এবং হাইফার আশপাশে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের সংমিশ্রণে আরেকটি আক্রমণ করার কথা বিবেচনা করছেন, তবে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা এড়াতে হবে।’
তারা জানিয়েছেন, এছাড়া পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির কাছে বিবেচনাধীন আরেকটি বিকল্প হচ্ছে- ইরান এবং অন্যান্য ফ্রন্ট থেকে সমন্বিত আক্রমণ চালানো, অর্থাৎ ইয়েমেন, সিরিয়া এবং ইরাকসহ যেখানে ইরান-সংশ্লিষ্ট মিত্র বাহিনী রয়েছে।
ইরানি এই কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, ইরানের সমস্ত রাষ্ট্রীয় বিষয়ে খামেনির কথাই শেষ কথা এবং তিনি দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কও বটে। যুদ্ধ আরও প্রসারিত হলে এবং ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালালে সেক্ষেত্রে ক্ষেত্রে আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষা উভয় বিষয়েই পরিকল্পনা তৈরি করতে বিপ্লবী গার্ড এবং সেনাবাহিনীর সামরিক কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন খামেনি।
এদিকে হানিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে নিজের প্রকাশ্য বিবৃতিতে খামেনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরান সরাসরি প্রতিশোধ নেবে। তিনি বলেছেন, আমরা তার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়াটা আমাদের কর্তব্য হিসেবে দেখছি, কারণ এই ঘটনা ইরানের ভূখণ্ডে ঘটেছে।
কে এই ইসমাইল হানিয়া?
ইরানের রাজধানী তেহরানে হত্যার শিকার হয়েছেন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। এক বিবৃতিতে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে হামাস। তবে কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত তথ্য জানায়নি ইরান। তবে দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে।এদিকে গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলার পর নতুন করে সবার নজরে আসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তখন থেকেই বিশ্ব গণমাধ্যমে বহুল চর্চিত একটি নাম ইসমাইল হানিয়া। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক কে ইসমাইল হানিয়া।
ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধানের পদে থাকলেও তাকেই এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা মনে করা হয়। তার পুরো নাম ইসমাইল আবদুস সালাম আহমেদ হানিয়া। তিনি ১৯৬৩ সালের ২৯ জানুয়ারি গাজা উপত্যকার আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার আদি নিবাস ইসরাইলের অন্তর্গত আশকেলনে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় তার বাবা মা আশকেলন ছেড়ে উদ্বাস্তু হন।
শিক্ষাজীবনের প্রথমে হানিয়া গাজার আল-আজহার ইনস্টিটিউটে এবং পরে গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানেই তিনি আরবি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকাকালীন তিনি হামাসের অগ্রদূত ইসলামিক ছাত্র ব্লকে যোগদান করেন।
গত শতকের আশির দশকে হামাসের উত্থানকালে ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিমদের এই রাজনৈতিক ও সামরিক আন্দোলনের সামনের কাতারে ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসরাইল। এরপর ১৯৯২ সালে আরও কয়েকজন হামাস নেতার সঙ্গে হানিয়াকে ইসরাইল ও লেবানন সীমান্তের শূন্যরেখায় ছেড়ে দেয় ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘ এক বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসমাইল হানিয়া গাজায় ফেরেন। ১৯৯৭ সালে হামাসের মতাদর্শিক গুরুর কার্যালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পান তিনি। এতে হামাসে তার পদমর্যাদা বাড়ে।
ফিলিস্তিনের জাতীয় নির্বাচনে হামাস বেশির ভাগ আসনে জয় পাওয়ার পর ২০০৬ সালে ইসমাইল হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজায় মাহমুদ আব্বাসের দল ফাত্তাহর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়াকে সরিয়ে দেয়া হয়। তবে হানিয়া ওই সিদ্ধান্তকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, তার সরকার ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের জাতীয় দায়িত্ব থেকে সরবে না এবং তিনি গাজা শাসন করতে থাকেন।
পরে ২০১৭ সালে ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। পরের বছর ইসমাইল হানিয়াকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। গত কয়েক বছর ধরে ইসমাইল হানিয়া কাতারে বসবাস করে আসছিলেন।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়