ফয়সাল আলম: সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংস ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যার কারণে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই চ্যালেঞ্জের বড় অংশজুড়েই একটি প্রশ্ন– ‘কুল রাখি, না শ্যাম রাখি’। এটা (‘কুল রাখি, না শ্যাম রাখি’) করতে গিয়ে দু’মুখী চাপে পড়েছেন গণমাধ্যমে কর্মরত লোকজন। একদিকে সরকারি চাপ, আরেকদিকে মাঠ-ঘাটে আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়ার ভয়। অথচ সাংবাদিকতা রাষ্ট্র ও জনসাধারণের কল্যাণে। গণমাধ্যম সেই কল্যাণ করতে পারছে কিনা? না পারলে কেন পারছে না? এমন অনেক প্রশ্ন গণমাধ্যমকর্মীদের। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ কি তাহলে কাগজ-কলমে–এমন প্রশ্নও উঠছে?
সাংবাদিক কোনো দলের না, কারও স্বার্থের না, এমনকি দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করবেন– এটাই প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ। কিন্তু সেটি কি হচ্ছে? বিশেষ করে টেলিভিশনে যারা কাজ করেন, তাদের কাজের পরিধি কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে? একটি উদাহরণ বলি, সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক সাংবাদিক ঝুঁকির বিষয় বুঝতে পেরে পেশা থেকে অব্যাহতি নেবেন এমনটা ভাবছেন। তার আগে তিনি আমার কাছে পরামর্শ চাচ্ছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে কী করা দরকার। তিনি জানান, অফিসকে বিভিন্ন সময় ঝুঁকির কথা জানালেও সেটি আমলে নিচ্ছে না। যেভাবেই হোক, তাঁকে অফিস নির্দেশনা মানার কথা বলা হয়েছে। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় এমন ঝুঁকির পাশাপাশি আস্থার সংকটও বেড়েছে। অন্যদিকে সাংবাদিকতার কাজ যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়, তাহলে সাংবাদিকতার দরকার কী? গুজব, মিথ্যা আর চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য সমাজ তথা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা বাড়ানো ছাড়া কমাবে না। তাই দিন শেষে মূল গণমাধ্যমের ওপরই সাধারণ মানুষের ভরসা।
অথচ সেই গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন, মাঠে যা ঘটছে তা টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছে না (যেহেতু আন্দোলন চলাকালে টেলিভিশনের ওপর চোখ ছিল মানুষের)। যা দেখানো হয়, তা কাটপিস করে। দর্শকের এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। যে কারণে টেলিভিশন সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ ভয়াবহ রকমের।
এমনিতেই সাংবাদিকতাকে বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। তাই বলে দাবার ঘুঁটি হয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনব? অর্থাৎ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে পুরো পেশাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ইচ্ছা করলেও একজন সাংবাদিক যা-তা লিখতে পারেন না বা দেখাতে পারেন না।
যেহেতু সাধারণ মানুষ এসব জানে না, তাই ঝুঁকিই এখন যেন ভরসা। টেলিভিশন সাংবাদিকদের বাঁচার পথ যেন পরিচয় গোপন করা, অথচ ইচ্ছা করলেই পরিচয় গোপন করার সুযোগ কম। পত্রিকার সাংবাদিকরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে পারেন খুব সহজেই। ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন থাকার ফলে টেলিভিশন সাংবাদিকদের সেই সুযোগ কম। যদিও ইদানীং ঝুঁকির কারণে অফিস লোগো খুলে মাঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তাতেও ঝুঁকি কমেছে বলে মনে হয় না।
সাংবাদিকতার যে ক্রান্তিকাল তার জন্য সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশির ভাগ সাংবাদিক সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করার সৎ সাহসের চেয়ে বড় করে দেখছেন স্বার্থকে। তাদের কেউ কেউ স্বার্থ খুঁজতে গিয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করছেন, কেউ পকেট ভরছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছেন মাঠের সাংবাদিকরা। আবারও বলছি, কেউ পরিচয় গোপন রাখছেন, কেউবা মার খাচ্ছেন। সামনের দিনে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা এ চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকির মুখে কতটা টিকে থাকতে পারবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে এ তথ্যও রয়েছে, গত কয়েক বছরে অনেক সাংবাদিক পেশা ছেড়েছেন, অনেকে দেশ ছেড়েছেন এবং ছাড়বেন। পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং নানা টেনশন, তার ওপর সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ পুরো পেশাকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। এ সংকট দেশকেও সংকটে ফেলবে। তাই সময় এখন গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার, বাঁচিয়ে রাখার।
ফয়সাল আলম: অপরাধ ও অনুসন্ধান বিভাগের প্রধান, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত