ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : চলমান বন্যায় এখন পযর্ন্ত দেশে ১১টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন। এ মুহূর্তে ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ পরিবার পানিবন্দি। আর এই বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৫ জন। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার পর ফেনী সদরের বোগদাদিয়া এলাকার বাগদাদ কনভেনশন সেন্টারে আশ্রয় নেন নুরুল আবসার। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। পরিবারের আরও ছয় সদস্যের ঠিকানা এখন ওই আশ্রয়কেন্দ্র।
নুরুল আবসার শুক্রবার দুপুরে বলেন, তিন দিন আগে তাঁদের বাড়িঘর ডুবে যায়। রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকমে সেন্টারে এসে আশ্রয় নেন। একটি কক্ষে আরও অনেক বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে থাকছেন। দুদিন ধরে একটি দানাও পেটে পড়েনি। সবার অবস্থা একই।
ঘরবাড়ি হারিয়ে ওই অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে মাথা গুঁজেছেন গোলাপ মিয়া (৫০)। পশ্চিম ছনুয়ায় তাঁর বাড়ি। দুই ছেলে ও স্ত্রী আছেন সঙ্গে। গোলাপ মিয়া জানান, পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, ভোগান্তিও বাড়ছে। খাবার নেই, পানি নেই।
বাগদাদ কনভেনশন সেন্টারটি তিনতলা। নিচতলা পানিতে সয়লাব। বাকি তলার আট কক্ষে কয়েক শ মানুষ তিন দিন ধরে থাকছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা গতকালও পুরোপুরি বন্যাকবলিত ছিল। সদর ও সোনাগাজী উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এ ছাড়া অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দী। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।
আবার কয়েক লাখ মানুষ স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। খাবার ও পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। যদিও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুকনা খাবার বিতরণ করছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ফেনীতে বন্যায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।
মূলত ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের কারণে ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ দিন ধরে মানুষ পানির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
দুর্বিষহ জীবন
১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বোগদাদিয়া এলাকায় বোগদাদিয়া উচ্চবিদ্যালয় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। চারতলার দুটি ভবন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে অর্ধশতাধিক কক্ষ। কোনো কক্ষে ৫০ জন, কোনোটিতে ৬০ জন পর্যন্ত থাকছেন। আবার কারও ঠাঁই হয়েছে বারান্দায়। সব মিলিয়ে দেড় হাজারের কম নয়।
গতকাল বেলা ৩টায় কিছুদূর পানি হাতড়ে এবং কিছুদূর নৌকাযোগে দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছান এ প্রতিবেদক। যেতে যেতে মনে হলো, পুরো গ্রাম আস্ত এক নদীতে পরিণত হয়েছে। বয়ে চলেছে অথৈ পানির প্রবাহ।
পরে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেখা যায়, ভবনের নিচতলা ডুবে আছে। কোনো নৌকা গেলেই গ্রামবাসী ত্রাণের আশায় কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে আসছিলেন। কাপড়চোপড়, ব্যাগ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে দুর্বিষহ সময় পার করছেন বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। কক্ষগুলোয় অনেকটা নিশ্বাস দূরত্বে মানুষ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে জীর্ণ পরিবেশ। শৌচাগারেও বন্যার পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। খাবার পানির সংকট আছেই।
খাদিজা বেগমের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বুধবার পরিবারের আরও পাঁচ সদস্য নিয়ে আশ্রয় পেতেছেন তিনি। খাদিজা বেগম জানান, সাত কামরার মাটির ঘর ছিল তাঁদের। বুধবার বাড়িতে হাঁটুসমান পানি ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে পুরোপুরি ডুবে যায়। পানি যখন বাড়ছিল, তখন ধীরে ধীরে ঘর ভেঙে পড়েছে। চোখের সামনে ৫০ বছরের পুরোনো বাড়িটি ভেঙে পড়েছে।
খাদিজা বেগমের দুই ছেলে। বড় ছেলে নুর সালাম (৩০) পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটা ঘর তোলার মতো পরিস্থিতি নেই। কোনো জিনিসপত্র বের করতে পারিনি। কয়েকটা কাপড় নিয়ে বের হয়েছি।’
নুর তাঁর অনিশ্চয়তার গল্প তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, যে বেতন পান, তা দিয়ে সংসরাই চলে না। এখন আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। ভাড়া বাসায় উঠতে হবে।
কথা হয় সাবিনা আক্তারের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি প্রশ্ন করলেন, কত দিন থাকতে হবে, পানি নামতে লাগবে কত দিন? সাবিনা বলেন, অকল্পনীয় ভোগান্তিতে আছেন তাঁরা। হঠাৎ বন্যায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে।
খাইয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও আশ্রয় পেতেছেন কয়েক শ মানুষ। ছোট ছোট কক্ষে দিন-রাত পার করছেন তাঁরা। কল্পনা রানি দাস জানান, মুড়ি, বিস্কুট, চিড়া দিয়ে গেছেন অনেকে। এভাবে কত দিন থাকবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
উদ্ধারে স্বেচ্ছাসেবীরা
ফেনী সদরের বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম নগর থেকে যাওয়া একটি দল। তারা দুটি বোটে ৭০ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়েছে। এই দলের সদস্য ইভেন মীর প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের পর গ্রাম ডুবে আছে। ভবনের ছাদে আটকা পড়াদের উদ্ধার করা হচ্ছে। অনেককে খাবার দেওয়া হচ্ছে।
ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর, মোটবী ও ধর্মপুর ইউনিয়নে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছেন সীতাকুণ্ডের একদল স্বেচ্ছাসেবক। দলের সদস্য নাজমুল ইসলাম জানান, পাঁচটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অন্তত ২০০ মানুষকে তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্র ও মহাসড়কে পৌঁছে দিয়েছেন।
তবে বিস্তীর্ণ এলাকার অনেকেই গতকাল রাত পর্যন্ত আটকে ছিলেন। ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টংগিরপাড় হাজী বাড়ি মসজিদ এলাকায় এক পরিবারের সাতজন আটকে আছেন। ওই পরিবারের আরেক সদস্য শিক্ষক ফারজানা আক্তার বলেন, এলাকাটি পুরো ডুবে গেছে। শিশুসহ তাঁর পরিবারের সাতজন আটকে আছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে তাঁদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
ফারজানা আক্তার সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর ভাবি তানিয়া আক্তারের সঙ্গে খুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। খুদে বার্তায় ভাবি জানিয়েছেন, তাঁরা সবাই এলাকার একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। ভবনের এক তলা ডুবে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। মসজিদে গ্রামের কয়েক শ মানুষ আছেন। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় কেউ বের হতে পারছেন না। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার তৃতীয় দিন গতকাল শুক্রবার বৃষ্টি না হওয়ায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও বিপদসীমার ওপরই রয়েছে। ফলে নদ-নদীর বাঁধ উপচে ও ভাঙন এলাকা দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল কয়েকটি স্থানে পানি কিছু কমে আসলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় তৃতীয় দিনে এসে বন্যাদুর্গত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণতৎপরতা শুরু হলেও বেশির ভাগ এলাকায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে মানুষের। বিশেষ করে ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলার ঘরবাড়ি এখনো চার-পাঁচ ফুট পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার মানুষের মাঝে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। বেঁচে থাকার লড়াই চলছে সর্বত্র। সরকারি হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত বন্যায় ১৩ জনের মৃত্যু এবং ১১ জেলার ৭৭ উপজেলায় ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল বৃষ্টি না হওয়ায় এবং আজ শনিবারও তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
আক্রান্ত ৯ লাখ পরিবার : গতকাল সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান জানান, চলমান বন্যায় দেশের ১১ জেলার ৭৭টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভা ৫৮৪টি। এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত
লোকসংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩৫ জন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি। তিনি বলেন, বন্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে ফেনীতে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে।
সচিব জানান, বন্যায় এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় চার জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে দুজন, নোয়াখালীতে একজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন ও কক্সবাজারে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন নারী। তিনি জানান, এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবায় মোট ৬৩৭টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ১৫০ টন চাল ও ১৫ হাজার খাবারের প্যাকেট বিতরণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহের জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিক্যাল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
ফেনী : বন্যার কারণে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ফেনীতে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সর্বত্রই মানুষের মাঝে খাবার সংকট আর বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছুটে চলা মানুষের দৃশ্য দেখে মনে হবে রাজপথে মিছিল চলছে। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যাকবলিত গ্রামে গ্রামে খাবার নেই। জীবন বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ছুটছে শহরের দিকে। কেউ আবার স্বজনদের মায়ায় ছুটে যাচ্ছেন গ্রামের দিকে। ছুটে চলা মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। তাদের কেউ নারী, কেউ শিশু, কেউ প্রবাসী আবার কেউবা অন্তঃসত্ত্বা। সবার বক্তব্য বাঁচাও আর খাবার দাও। উদ্ধারকারীদেরও হিমশিম অবস্থা। তারা যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে সবাই খাবার চাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত রহুল আমীন জানান, ফেনীর ১৬ লাখ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখন সবার আগে প্রয়োজন সব জায়গায় খাবার পৌঁছানো।
কুমিল্লা : বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রাত পৌনে ১২টায় বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুরবুড়িয়া গ্রামে গোমতী নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। সেখানে ভাঙন প্রায় ৩০০ ফুট ছাড়িয়েছে। ইতেমাধ্যে প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পনিবন্দি হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন হাজারো মানুষ। গতকাল অনাহারে-অর্ধহারে কাটে অনেকের। আক্রান্ত গ্রামের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বুড়িচং ছাড়িয়ে পানির প্রবাহ ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলা এবং আশপাশের উপজেলায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত অনেকেই আটকা পড়েছিল প্লাবিত এলাকায়। উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবক ও প্রশাসনের লোকজন উদ্ধারকাজ করছে। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টায় বাঁধভাঙা পানি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সাহেবাবাদ, মালাপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়া সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপÍ পরিমাণে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে বলে জানা গেছে। বুড়িচং উপজেলার মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার কারণে কুমিল্লায় চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজন বন্যার পানিতে তলিয়ে, একজন বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং আরেকজন মাথায় গাছ পড়ে মারা যান। তারা হলেন নাঙ্গলকোট পৌরসভার দাউদপুরের কেরামত আলী (৪৫), কুমিল্লা নগরীর ছোট এলাকার রাফি (১৫), চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাকাটিয়া গ্রামের কানু মিয়ার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৩৪) ও লাকসামের আলিম পরীক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ শিহাব (১৬)।
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি না হলেও বন্যার পানি স্থির রয়েছে। এসব অঞ্চলে এখনো মানুষের বসতবাড়ি ডুবে আছে পানিতে। জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় ৬ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁটু পরিমাণ পানি জমে আছে। দুর্গতদের মাঝে সরকারি- বেসরকারিভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে সদর উপজেলার পৌরসভা, ভবানীগঞ্জ, কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রাম (স্মার্ট ভিলেজ), রামগতি উপজেলার চরবাদাম ও চরপোড়া গাছা ইউনিয়ন ঘুরে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়। রামগতির চরবাদাম ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকার পূর্ব পাশে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ঘরের ভেতর ৪-৫ ফুট পানি।
চকরিয়া (কক্সবাজার) : জেলার চকরিয়ায় তিন শিশু বাড়ি থেকে বের হয়ে নিকটতম বাজারে যাচ্ছিল। পথে পাহাড়ি ঢলের স্রোতে ভেসে যায় তিনজনই। তাদের মধ্যে দুজন সাঁতরিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পারে। পরে মো. হাবিব (১৩) নামে এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পহরচাঁদা বিবিরখিল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চকরিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী ও বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ফটিকছড়ির। এখানকার ২২টি ইউনিয়নের সবকটি প্লাবিত হয়েছে। তবে গতকাল শুক্রবার বৃষ্টি না হওয়ায় কয়েকটি এলাকা থেকে পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের প্রাণহানির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই ও হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দা। ফটিকছড়ির ইউএনও মোজাম্মেল বলেন, দাঁতমারা, নারায়নহাট ও ভুজপুরে ইউনিয়নের এক শিশুসহ দুজনের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি। রাঙ্গুনিয়ায় মারা যান দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রনি (১৭)। শুক্রবার সকালে হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ইউসুফ চৌধুরীর বাড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জিয়াউর রহমান সাকিব (২২) নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, গতকাল চট্টগ্রামের ফেনী নদীর পানি কয়েকটি পয়েন্টে বিপদসীমার ২ মিটার ও হালদা নদীর পানি ১ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নদীর পাড় উপচে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নোয়াখালী : জেলা সদরসহ আটটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে জেলার প্রায় বিশ লাখের বেশি মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত জেলার প্রায় ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। বৃষ্টি কমলেও বন্যার পানি না কমায় বেশির ভাগ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আসা লোকজনের অভিযোগ, সরকারিভাবে তাদের খাদ্যসহ পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রের আশপাশে থাকা লোকজন ও সংগঠনের সহযোগিতায় আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে খাবার দেওয়া হচ্ছে।
হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। খোয়াই নদীর পানি কিছুটা কমলেও সব পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলায় খোয়াই বাঁধের জালালাবাদ ও লস্করপুরে ভাঙন দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। জেলার পাঁচটি উপজেলার ২২টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে।
খাগড়াছড়ি : বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় খাগড়াছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। যাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে, তারা আছেন খোলা আকাশের নিচে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে দুর্গতদের মাঝে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : জেলার আখাউড়ায় কমতে শুরু করেছে ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল সকাল থেকে আখাউড়ার গাজীবাজার, মোগড়া, মনিয়ন্দসহ বিভিন্ন গ্রামের ডুবে থাকা বাড়িগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুপুর নাগাদ দেড় থেকে দুই ফুট পানি কমে গেছে। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। দুই-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা করা হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে হাওড়া নদীর পানি নয় সেন্টিমিটারের মতো কমেছে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের রাজনগর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়ার বড়লেখা জুড়ি ও সদর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা গতকাল পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সদর, রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলা। অনেক স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। নতুন এবং পুরনো মিলিয়ে জেলার তিনটি নদীর ২০টি স্থানে ভাঙন দেখা দেওয়ায় ৩৭টি ইউনিয়নের ২১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত