অনুসন্ধানী সংবাদ

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেইনম্যান থেকে কোটিপতি মুজিবুর

1727213335 cffe39f5dfb145a267dd9263b1d0f3b5
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কমুজিবুর রহমান একসময় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (চেইনম্যান) ছিলেন। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন তিনি। কিন্তু এতেও থামেনি তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

নিজেকে কখনো সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আত্মীয়, আবার কখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মানুষকে ভয় দেখিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।

কখনো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েও করেছেন প্রতারণা। সাবেক সরকারের সময় ব্যাপক দুর্নীতি করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হন তিনি। মামলা হলেও কিছু পুলিশ কর্মকর্তার আশীর্বাদে পার পেয়ে যান।
ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বর্তমানে আইন উপদেষ্টার পিএসের আত্মীয় পরিচয়ে নতুন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

পুরনো মামলা তুলে নিতে এক ব্যবসায়ীকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী।

জিডিতে ব্যবসায়ী উল্লেখ করেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে ধানমণ্ডি এলাকায় দুই ব্যক্তিসহ এসে মুজিবুর রহমান তাঁকে এক সপ্তাহের মধ্যে মামলা তুলে নিতে বলেন। অন্যথায় মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেন।
এতে তিনি এখন পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

এ ব্যাপারে ধানমণ্ডি থানার ওসি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন  বলেন, ‘অভিযোগের তদন্ত চলছে। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সেসবেরও তদন্ত চলছে।’

শুধু এই অভিযোগই নয়, মুজিবুরের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

প্রাথমিক তদন্তে দুদক মুজিবুরের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পুকুরপারে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। তবে তিনি সপরিবারে ধানমণ্ডির ১১/এ নম্বর রোডে ৭৭ নম্বর বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় ২/এ ফ্ল্যাটের মালিক হিসেবে পরিচিত মুজিবুর। ফ্ল্যাটের মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। যাতায়াতের জন্য দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৬-৩০৩৯ এবং ঢাকা মেট্রো-গ-২৬-৪৪০৬) ব্যবহার করেন। দুটি গাড়ির জন্য দুজন চালক রয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও রয়েছে।

মোহাম্মদিয়া সুপারমার্কেটের ৭৯/৮০ নম্বর দোকানে খোলা হয়েছে কম্পানির অফিস। এ ছাড়া মুজিবুরের নামে-বেনামে একাধিক প্লট রয়েছে। বিভিন্নজনকে পূর্বাচলে প্লট কিনে দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েও জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। এক পর্যায়ে টাকা ফেরত চাইলে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা জিডি ও মামলা করেন তিনি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আত্মীয় ও আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়েও তিনি এভাবে অনেক দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মুজিবুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে করা একাধিক মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পরিচয়ে প্রতারণা করলেও প্রকৃতপক্ষে মুজিবুর রহমান খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেইনম্যান ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে এখন চাকরিচ্যুত। তিনি কখনো নিজেকে দুদকের উপপরিচালক, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েও প্রতারণা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি তিনি এক শিক্ষকের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন ওই শিক্ষক। কুমিল্লার এক ব্যবসায়ীকে প্লট দেওয়ার কথা বলে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন আরো অন্তত ১১ জন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ নানা পেশার লোকজনের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একাধিক দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে অনেক মানুষকে ধোঁকা দিয়ে টাকা বাগিয়েছেন মুজিবুর। ধানমণ্ডি এলাকার এক সাবেক কাউন্সিলরকেও অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করতেন তিনি। রয়েছে তাঁর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।

মুজিবুর রহমানের দুর্নীতির অভিযোগে এর আগে ধানমণ্ডি থানায় করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন আরো অনেক তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ওই মামলায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর মুজিবুরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই।

প্রতারণার অভিযোগে গত বছর ৩ মার্চ মুজিবুরের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় মামলাটি করেন মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক ঠিকাদার। পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, ছয় বছর আগে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে তিন কোটি টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কেনেন মুজিবুর রহমান। তখন তিনি নিজের পরিচয় দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। এই মিথ্যা পরিচয়ে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও হন।

কিছুদিন পর মুজিবুর জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিনি রাজউকে অথরাইজড কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়েছেন। বিশ্বাস করে তখন মুজিবুরের কাছে একটি প্লট কেনার বিষয়ে সহায়তা চান মোস্তাফিজুর রহমান। তবে প্লট বিক্রির নাম করে প্রতিবেশী মোস্তাফিজুরের সঙ্গেও প্রতারণা করেন মুজিবুর। তিনি (মুজিবুর) মোস্তাফিজের কাছ থেকে তিন কোটি সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তবে সেই প্লট এখনো নিবন্ধন করে দেননি তিনি। এ নিয়ে চাপ দেওয়ায় তিনি উল্টো মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান  বলেন, মোস্তাফিজুরের কাছে প্লট বিক্রির নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মুজিবুরের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তদন্তে তার সত্যতা পাওয়া গেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয়ে যেসব দুর্নীতি করছেন, তদন্তে এসব অভিযোগেরও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরই মুজিবুরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, মুজিবুর রহমান ১৯৯৮ সালে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেইনম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১০ বছর সেখানে কর্মরত ছিলেন তিনি। তাঁকে ২০০৮ সালে রাজউকের অফিস সহায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। পরে তাঁকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এরপর ২০১৯ সালে তাঁকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। পরে বদলি করা হয় বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে। তবে যোগদানের এক মাস পর থেকে তিনি কর্মস্থলে আর যাননি। ২০২০ সালে কর্মস্থলে অনুপস্থিত, অসদাচরণ ও অবহেলার কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি ধানমণ্ডির বাসিন্দা। একই ভবনে থাকার সুবাদে মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে। মুজিবুর নিজেকে রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তা পরিচয় দেন। পূর্বাচলে একটি প্লট কিনে দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে তিন কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা নেয়। এ জন্য একটি অঙ্গীকারনামায় সই করি আমরা। পরে প্লট কিনে না দিয়ে মুজিবুর দুর্নীতি করে। প্লট না হয় টাকা ফেরত চাইলে সে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন টাকা চাইতে গেলে স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমাকে ও পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়।’ এ নিয়ে মুজিবুরের বিরুদ্ধে এর আগে ধানমণ্ডি থানায় একটি জিডি করেন তিনি। এতে মজিবুর ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেন।

এ বিষয়ে ধানমণ্ডি সোসাইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মজিবুর অনেক আগে আমাদের সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। তখন তিনি নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু পরে জানতে পারি, তিনি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। নানা অনিয়মের কারণে তাঁর চাকরি চলে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কাছেও অভিযোগ আসছে। তাঁর সদস্য পদ বাতিলের জন্য আমরা বসব।’

ভবনের বাসিন্দাসহ আরো কয়েকজন ভুক্তভোগী তাঁর বিরুদ্ধে দুদকেও অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগটি অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী মোস্তাাফিজুর রহমানের করা মামলায় মুজিবুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *