আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান,নষ্ট করা হচ্ছে আলামত


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা :আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার মতো ঘটনায় কেউ কেউ গুম হয়েছেন। কেউবা রাজনৈতিক কারণে; কখনো জঙ্গি সন্দেহে। আর ব্যবসা ও পারিবারিক কারণেও অনেকে গুম হন। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনে জমা হওয়া অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে গুমের এই চারটি কারণ পেয়েছেন কর্মকর্তারা।
গত ১৫ বছরে গুমের শিকার হয়েছেন এমন ১ হাজার ৬০০-এর বেশি অভিযোগ পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। প্রাথমিকভাবে সেগুলোর ৩৮৩টি তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা গুমের চারটি কারণ পেয়েছে এ কমিশন। এসব কারণে ভুক্তভোগীদের গুম করা হয়েছে।
কমিশন জানিয়েছে, এরই মধ্যে অভিযোগকারীদের মধ্য থেকে ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও কমিশনের অনুসন্ধানে গুমের সঙ্গে অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নাম বেরিয়ে আসছে। ৩৮৩টি অভিযোগ পর্যালোচনা করে কমিশন জানিয়েছে, র্যাবের বিরুদ্ধে ১৭২টি, ডিবি ৫৫টি, সিটিটিসি ৩৭টি, ডিজিএফআই ২৬টি, পুলিশ ২৫টি ও অন্যদের ৬৮টি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে কমিশন। আগামী ৭ নভেম্বর ডিরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বাহিনীর সাতজনকে কমিশন জিজ্ঞাসাবাদ করবে। জড়িত বাকিদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে কমিশন চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জাতীয় বা জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, দলীয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে বন্দিশালার সৃষ্টি। জনস্বার্থে বা জাতীয় স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
গুমের কারণগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচক ছিলেন। হয়তো ফেসবুকে লিখেছেন। সেসব কারণে গুম হয়েছেন। অনেকে চিহ্নিত করতে পারেননি, কারা করেছে। কিছু লোক গুমের শিকার হয়েছেন, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। গুম হওয়াটাই একটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। বাহিনী ছাড়াও ভাড়াটিয়া দিয়ে গুম হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক আসামিকে চার-পাঁচ দিন ধরে রাখছে, কোনো মামলা বা আদালতে ফরোয়ার্ডিং না করেই তারা রেখেছে।’
গুমের শিকার হওয়ার পর ফিরে আসা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এগুলো একটা স্বাধীন দেশে কল্পনা করা যায়? আট বছর আয়নাঘরে বা ডিটেনশন সেন্টারে, কোনো বিচার ছাড়া। এগুলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আটকে রাখা এগুলো অবৈধ এবং সংবিধানবহির্ভূত ঘটনা।’
তিনি বলেন, এই কমিশন মনে করে, গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত। যাদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের তলবের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
কাদের তলব করা হয়েছে এবং গুমের সঙ্গে কোন কোন বাহিনীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম বলেন, ৭ তারিখ থেকে শুরু করেছি। প্রথম দিন সাতজন। ডিজিএফআইসহ অন্যরা আছেন। প্রাথমিকভাবে এখন পর্যন্ত ডিজিএফআই, র্যাব, ডিবি, সিটিটিসি, পুলিশ, সিআইডির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের ডাকা শুরু হয়েছে। তাদের স্টেটমেন্ট শোনার পর বুঝতে পারব অ্যাকচুয়াল সিনারিটা কী। নরমালি তারা না করবে। জানি না, এটা-সেটা বলবে। তবে সেসব অ্যাভিডেন্স কমিশনের হাতে আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। আমাদের নিজস্ব একটা মেকানিজম আছে। যেটা দিয়ে কাজ করা হবে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গোপন বন্দিশালা থেকে তিনজন ফিরে আসার খবর পাওয়া গেছে। এখনো সন্ধান না পাওয়া সংখ্যাটা কত, জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, তিনজনের বাইরে আরও কয়েকজনের খবর পাওয়া গেছে। ফলে এখনই বলা যাচ্ছে না, ৫ আগস্টের পর ঠিক কতজন বেরিয়ে এসেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা তথ্যানুযায়ী, এখনো ২০০-এর মতো মানুষ ট্রেসলেস (নিখোঁজ) আছে। তাদের বিষয়ে বলা যাচ্ছে না, গুম কী, গুম না। তবে অধিকাংশের অভিযোগ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে।
এ ছাড়া ২২টি অভিযোগ পাওয়া গেছে, যেগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা প্রাথমিকভাবে পায়নি কমিশন। এই ২২টি অভিযোগ কমিশনের আওতাভুক্ত না হওয়ায় পুলিশকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নষ্ট করা হচ্ছে গোপন বন্দিশালার আলামত:
সংবাদ সম্মেলনে কমিশন জানিয়েছে, আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো ডিজিএফআই, র্যাব-১, র্যাব হেডকোয়ার্টার, র্যাব-১১, র্যাব-২ (বসিলা), র্যাব-২ (আগারগাঁও), ডিবি ও সিটিটিসি কার্যালয়। কমিশনের ধারণা করছে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও গোপন বন্দিশালা পাওয়া যাবে।
নূর খান লিটন বলেন, একটা মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে দিন গণনা করে, তার ট্রেস কীভাবে রেখে যায়, এগুলোর প্রমাণ পেয়েছি। কারও কারও নামও আমরা পেয়েছি। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের থেকেও জঘন্য সেলের সন্ধান গুম তদন্ত কমিশন পেয়েছে। যেটা আমাদের কাছাকাছিই ছিল। সেগুলো পরিদর্শন করতে পেরেছি। সাড়ে ৩ ফিট বাই ৪ ফিট জায়গায় দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছে। পুরো বদ্ধ ঘর। একটা ছিদ্র ছিল। যেটা বাইরে থেকে বন্দিকে দেখার জন্য খোলা হতো। এটা র্যাবের তত্ত্বাবধানে পেয়েছি।
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বন্দিশালাগুলো ভিজিট করে বন্দি অবস্থায় কাউকে পাওয়া যায়নি। অনেক বন্দিশালা ধ্বংস করা হয়েছে। কিছু আগে ও কিছু পরে করা হয়েছে। সেলগুলো ৩ ফিট বাই সাড়ে ৬ ফিট। একটা কক্ষে এমন তিনটা সেল ছিল। এসব সেলের দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলেছে। সুতরাং এটা কী, বোঝার উপায় ছিল না। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা অনুযায়ী আমরা ওখানে গিয়ে পেয়েছি। ফ্লোরে প্লাস্টার করা হয়েছে। কিন্তু অরজিনাল প্লাস্টারের সঙ্গে তা তো মিলে না। ফলে বোঝা যায়, ভেঙে আলামত নষ্ট করা হয়েছে। সিলিং দেখে, ভেতরের টয়লেটের অংশ দেখেও বোঝা যায়। দায়িত্বশীলদের প্রশ্ন করলে বলে, আমরা তো আগে ছিলাম না। পরে এসেছি, জানি না।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।