ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :  গল্পটার শুরু যুগকাল আগে, আরব বসন্তের হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন স্বৈরাচার। সেই হাওয়া থেমে গিয়েছিল কিন্তু একদম ফুরিয়ে যায়নি। কোথাও কোথাও পতন ঘটিয়ে একটু থমকে গিয়ে আবার সচল হয়েছে স্বৈরাচার পতনের এই আলেখ্য সংগ্রাম। আরব বসন্তের সূচনায় শেষ হয়েছে সর্বশেষ বাশার আল আসাদের পতনের মাধ্যমে।

আরব বসন্ত ছিল ২০১০-২০১১ সালের একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন, যা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার একাধিক দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন, মানবাধিকার ও সমাজ পরিবর্তনের দাবি তুলে ধরে বিস্তার লাভ করে। এর শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়, যখন মোহাম্মদ বোজিজি নামক এক তরুণ বেকার প্রতিবাদ হিসেবে নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছিল। তার আত্মাহুতি দেশের জনগণের মধ্যে সরকারের দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করেছিল, যা অন্যান্য আরব দেশে আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।

এ আন্দোলনের ফলে তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন বা সংঘর্ষের সূচনা হয়। লিবিয়ায় পতন হয় ঐতিহাসিক স্বৈরাচার গাদ্দাফির। কিছু দেশে সরকার বদলালেও, অন্যত্র গৃহযুদ্ধ বা একাধিক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সিরিয়ায়, যেখানে বাশার আল আসাদ সরকার জনবিক্ষোভকে কঠোরভাবে দমন করতে শুরু করেছিল, তা এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এর ফলস্বরূপ, সিরিয়া এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সম্মুখীন হয় এবং লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে।

এমনকি কিছু দেশে আরব বসন্তের আন্দোলন বেশ তিক্ত ফলাফল এনে দেয়, যেমন শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকশের শাসন পতন, আফগানিস্তানে মার্কিন সরকারের ব্যর্থতা, এবং বাংলাদেশের মতো দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জনগণের অংশগ্রহণ। তবে, সবকিছুর মধ্যে যেমন আশার আলো ছিল, তেমনি ছিল অন্ধকার। আরব বসন্তের এই উত্তাল ইতিহাস বারবার মনে করিয়ে দেয় যে, জনগণের শক্তি ও প্রতিবাদের মাধ্যমেই পৃথিবী বদলাতে পারে, তবে সেই বদল কখনও সোজা পথ নয়।

সিরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭০-এর দশক থেকে আসাদ পরিবারের শাসন ছিল এক কঠোর শাসন ব্যবস্থা, যেখানে বাশার আল-আসাদ নিজেকে দেশের একমাত্র আধিপত্যবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত রাশিয়া ও ইরানের অস্থিরতার কারণে, তাঁর ক্ষমতার ভিত টলমল হয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ, যা বছরের পর বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি, অবকাঠামো ও মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, আজকে এক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কোটি কোটি সিরিয়ান মানুষ তার নিজ মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে, কিছু অংশ দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, যেখানে তারা প্রতিনিয়ত মানবিক সংকটের মুখোমুখি।

এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তখন বিদ্রোহীরা সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসকের পতনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা দাবি করেছে, সিরিয়ায় একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে, যেখানে অন্ধকার যুগের অবসান হয়েছে। আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া এক নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় বিভক্ত হয়েছে। তবে এই রাজনৈতিক পরিবর্তন, যদিও বিদ্রোহীদের জন্য বিজয়ের মুহূর্ত, তবুও সিরিয়ার সাধারণ মানুষ এই দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের শেষে শান্তির অন্ধকারে এখনও দিশাহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীরা, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার জনগণ জানে, এই বিপর্যস্ত দেশটি কোনো সহজ পথে পুনর্গঠন করা সম্ভব নয়। সিরিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে মানবিক পুনরুদ্ধার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন এক দুরূহ লক্ষ্যের মতো। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিরিয়ায় প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এবং এখনো লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমনকি দেশ ছাড়াও সিরিয়ার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।

২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করার পর, তারা দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এর ফলে, আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতির সমাপ্তি ঘটে এবং আফগান সরকারের পতন ঘটে। তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর, তারা একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও বেশ জটিল এবং তর্কিত।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকশের পতন ২০২২ সালের জুলাই মাসে ঘটে, যখন দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে এবং জনগণের প্রতিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক মন্দা, ঋণের বোঝা, খাদ্য ও জ্বালানির সংকট, এবং মূল্যস্ফীতি রাজাপাকশে সরকারের উপর জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, হাজার হাজার নাগরিক রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করে এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করে। অবশেষে, ৯ জুলাই ২০২২, প্রেসিডেন্ট রাজাপাকশে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং দেশ ছেড়ে পালান।

রাজাপাকশের পতনের ফলে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়, কিন্তু এটি দেশের জনগণের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল—এটি ছিল এক স্বৈরাচারের পতন, যেখানে জনগণের প্রতিবাদ এবং সংগ্রাম এক নতুন পথে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছিল। রাজাপাকশ পরিবারের শাসনামলের পর, শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার গঠন এবং দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, দেশটি এখনও সংকটে রয়েছে।

স্বৈরাচার পতনের এই ধারা এসে গণবিপ্লবের জন্ম দেয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের স্বৈরাচার হাসিনার ১৬ বছরের নৈরাজ্যের পতন ঘটে গত ৫ই আগস্ট। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান যখন তুখোড় আন্দোলনে রূপ নেয়, সারা ঢাকার মানুষ যখন গণভবনের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করে তখন এক কাপড়ে গণভবন ছেড়ে পালায় শেখ হাসিনা।

হাসিনার পতনের খুব বেশিদিন না যেতেই পতন হয় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাশার আল আসাদের বাবাও যেমন স্বৈরাচার ছিলেন তেমনি শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবর রহমানও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন।
যুগে যুগে যত স্বৈরাচারের জন্ম হয়, জন্ম হয় বিপ্লবীদেরও। স্বৈরাচারের হাত যতই শক্তিশালী হোক, বিপ্লবীরাও শক্ত হাতে ভেঙে দেয় স্বৈরাচারের মসনদ। ফেরাউনের মূর্তি ভাঙার মতোই বিপ্লবীরা লুটিয়েছে শেখ মুজিবের মূর্তি, হাসিনার মূর্তি এবং আসাদের মূর্তি। বিশ্বজুড়ে বিল্পবের আগুন ছড়িয়ে পড়ুক, জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক সকল স্বৈরাচারের গদি।

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।