বিদেশ ভ্রমণে প্রয়োজনীয় যেসব জিনিস সঙ্গে নেবেন


নতুন বছরের শুরুতে অনেকেই ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে, অফিশিয়াল কাজে বা পরিবারকে সময় দিতে সামর্থ্যবানদের অনেকেই বিদেশে ভ্রমণকে পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে রাখেন। কিন্তু ঘুরতে চাইলেই তো আর হবে না। নিষ্কণ্টক ভ্রমণের জন্য আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে দরকারি জিনিসপত্র। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই দরকারি জিনিসপত্রের পরিমাণ আরও একধাপ বেড়ে যায়।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর এর রহস্য ভেদ করতে অনেকেরই বিদেশ ভ্রমণ করতে ভালো লাগে। বিদেশে ভ্রমণ করতে চাইলে আপনার সঙ্গে যে দরকারি কাগজপত্র ও জিনিসপত্র সঙ্গে রাখতে হবে আসুন জেনে নেই আজকের আয়োজনে-
আপনি যদি বছরেরে শুরুতে বা এই শীতে বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে আপনার প্রথমেই যে জিনিসটির প্রয়োজন হবে তা হলো করোনা টিকা সনদ। মহামারি করোনাকালে এই কাগজ ছাড়া আপনার পক্ষে এখন আর বিদেশ ভ্রমণ করা সম্ভব নয়।
করোনার টিকা সনদ থাকলে আপনি বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনায় এগোতে পারেন। এরপর আপনাকে যেসব কাগজপত্র জোগাড় করতে হবে তা হলো বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট আর আপনি যে দেশে ঘুরতে যেতে চান তার ভিসা ও প্লেন টিকেট। ঘুরতে যাওয়ার আগে অবশ্যই এই দরকারি কাগজপত্রগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
আপনি যদি এই বিদেশ ভ্রমণ ব্যক্তিগত বাইক বা গাড়িতে করতে চান তাহলে এই ক্ষেত্রে আপনার প্লেন টিকিট সংগ্রহের ঝামেলা পোহাতে হবে না ঠিকই কিন্তু এই একটি ঝামেলা এড়াতে আপনাকে স্বাগত জানাতে হবে আরও তিনটি ঝামেলাকে।
নিজ গাড়ি বা মোটরসাইকেলে বিদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে যে ফরমালিটিস্টটি পূরণ করতে হবে তা হলো ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং পারমিট। এই ফরমালিটিস্টটি পূরণ করতে পারলে বিদেশের মাটিতে আপনি আপনার নিজ গাড়ি বা মোটরসাইকেলটিকে চালানোর অনুমতি পেয়ে যাবেন। এই অনুমতি পাওয়ার জন্য আপনার একটি ফরম পূরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে জমা দিতে হবে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি, পাসপোর্টের ফটোকপি, ৪ কপি স্টাম্প সাইজ ও ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
বাংলাদেশ অটো মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন এ বিষয়টি তদারকি করে থাকে। এর ঠিকানা হলো ৩ বি, আউটার সার্কুলার রোড, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। তাই ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে এখানেই আপনার পূরণকৃত ফরমটি জমা দিন। ২৫০০ টাকা ফি দিয়ে জমা দেওয়ার পর প্রায় ১২ দিন বা ২ সপ্তাহের মধ্যে আপনি আপনার অনুমতিটি পেয়ে যাবেন।
এরপরেই আপনার যে অনুমতিটির প্রয়োজন হবে তা হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অনুমতি। এটি পাওয়ার জন্য আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে একটি এপ্লিকেশন জমা দিতে হবে। এরজন্য কোনো টাকার প্রয়োজন নেই। তবে আপনাকে অ্যাপলিকেশনের সঙ্গে জমা দিতে হবে ভিসা, পাসপোর্ট, গাড়ি বা মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন পেপার, ইন্সুরেন্স, স্মার্টকার্ড, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং পারমিট ইত্যাদির ফটোকপি ও ছবি। এই অনুমতি পেতে আপনার প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগবে। অনুমতি পাওয়ার পর এই অনুমতিপত্রটির এক কপি আপনার কাছে রেখে আরেক কপি জমা দিতে হবে বর্ডার কাস্টমস অফিসে।
এরপর আপনাকে পেতে হবে কারনেট। এটি হলো যেকোনো দেশে যানবাহন চালানোর অনুমতি। অন্যদেশে যেকোনো গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে আপনাকে সব সময়ই এটি সঙ্গে রাখতে হবে। এটি ইস্যু করার সময় আপনার বাইক বা গাড়ির মূল্যের সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি বা পে অর্ডার জমা দিতে হবে যা অবশ্যই ফেরতযোগ্য। সাধারণত কারনেট ইস্যু করতে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকার মতো লাগে। তবে এখানে অবশ্যই অনুমতি পত্র পাওয়ার আবেদনে আপনি কোন বর্ডার পাস করবেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।
আপনার এইসব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ হয়ে গেলে আপনি বিদেশ ভ্রমণের জন্য তৈরি বলা যায়। তবে যেদিন ভ্রমণের জন্য বের হবেন প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে বর্ডারে চলে যাবেন ৩ থেকে ৪ ঘন্টা আগে। এখানে ৩০০ টাকার ইন্ডেমনিটি বন্ড এবং গাড়ির জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অনুমতিপত্র দেখিয়ে কমিশনার অফিসে জমা দিন। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে কাস্টমস অফিসে অ্যাসিস্টেন্ট রেভিনিউ অফিসারের কাছে কারনেটসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট জমা দিন। এসব কাগজপত্র অবশ্যই ভ্রমণের পর আবার ফেরত নিয়ে নেবেন।
আপনার বিদেশ ভ্রমণের জন্য এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ হয়ে যাওয়ার পর আপনার ব্যক্তিগত ভ্রমণ ব্যাগ গোছানোর পালা। এই সময় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে ফার্স্ট এইড বক্স। অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো ছোটখাটো দুর্ঘটনা এড়াতে আপনি অবশ্যই প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে ফার্স্ট এইড বক্স নিতে ভুলে যাবেন না।
বিদেশের মাটিতে ভ্রমণের সময় কোথায় থাকবেন এবং করোনাকালীন সময়ে সেসব দেশে কী বিধিনিষেধ চলছে সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আগেই সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন। আপনার ভ্রমণের পছন্দের স্থানটি সম্পর্কেও রাখুন বিস্তারিত তথ্য।
ভ্রমণের সময় সঙ্গে রাখুন শীতের পোশাক। বাইরে ব্যবহার করুন মাস্ক। আর পছন্দের জায়গা ভ্রমণের সময় অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। তাহলেই আপনি পাবেন প্রকৃত ভ্রমণের আনন্দ।
গন্তব্য নির্বাচন ও গবেষণা করুন
বিদেশ ভ্রমণের প্রথম ধাপ হলো গন্তব্য নির্বাচন। এমন কোনো দেশ বা শহর বেছে নিন, যেটি আপনার পছন্দের তালিকায় রয়েছে এবং যা আপনার বাজেট ও সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।গন্তব্য নির্বাচনের পর ঐ স্থানের আবহাওয়া, ভ্রমণের উপযুক্ত সময়, সাংস্কৃতিক প্রথা, দর্শনীয় স্থান এবং স্থানীয় খাবার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
ভিসা ও পাসপোর্ট প্রস্তুত করুন
বিদেশ ভ্রমণের জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি হলো পাসপোর্ট। যদি আপনার পাসপোর্ট না থাকে, তাহলে দ্রুত আবেদন করুন। যারা আগে থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন, তারা নিশ্চিত করুন এটি বৈধ রয়েছে এবং মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে রি-নিউ করুন।গন্তব্য দেশ অনুযায়ী ভিসা প্রক্রিয়া শুরু করুন। ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, আবেদন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকেই ভালোভাবে জেনে নিন। কিছু দেশে ভিসা প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে, তাই সময় হাতে রেখে কাজটি করুন।
ফ্লাইট এবং থাকার ব্যবস্থা
ফ্লাইট বুকিং করার সময় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ভাড়া তুলনা করুন। অনেক সময় অগ্রিম বুকিং করলে তুলনামূলক কম খরচে প্লেনের টিকিট পাওয়া যায়।থাকার জন্য হোটেল, রিসোর্ট অথবা এয়ারবিএনবির মতো সুবিধাগুলো যাচাই করে আপনার বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী ঠিক করুন। থাকার জায়গা নির্বাচন করার সময় লোকেশন এবং রিভিউ দেখুন।
ভ্রমণ বিমা করান
অনেকেই ভ্রমণ বিমার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। এটি আপনাকে স্বাস্থ্য সমস্যা, যাত্রা বাতিল বা জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষা দেয়। তাই ভ্রমণের আগে একটি ভালো ভ্রমণ বিমা পলিসি বেছে নিন।
আর্থিক প্রস্তুতি নিন
বিদেশে থাকাকালীন অর্থব্যবস্থাপনার জন্য আপনার ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সক্রিয় আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। পাশাপাশি, কিছু পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা সঙ্গে রাখুন।মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর থেকে মুদ্রা পরিবর্তন না করে শহরের মধ্যে নির্ভরযোগ্য মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টার ব্যবহার করুন। এতে আপনি ভালো রেট পাবেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন
আপনার পাসপোর্ট, ভিসা, ফ্লাইটের টিকিট, হোটেল বুকিং এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের কপি রাখুন। এগুলোর হার্ডকপি ও সফটকপি (মোবাইল বা ইমেলে সংরক্ষিত) রাখুন।কোনো কোনো দেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নথি (যেমন, ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট) দেখাতে হতে পারে। এগুলোও আগে থেকে তৈরি করে নিন।
ভ্রমণের জন্য প্যাকিং করুন
বিদেশ ভ্রমণের জন্য সঠিকভাবে ব্যাগ প্যাক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়া ও গন্তব্য অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করুন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন পাসপোর্ট, পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার, ক্যামেরা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিন।মনে রাখুন, অতিরিক্ত জিনিস বহন করবেন না। ভারী লাগেজ ভ্রমণে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি
বিদেশে ভ্রমণের সময় যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক রোমিং বা একটি স্থানীয় সিম কার্ড কেনার পরিকল্পনা করুন। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে একটি পোর্টেবল ওয়াই-ফাই ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।বিদেশি রাস্তায় নেভিগেশনের জন্য গুগল ম্যাপস বা অন্য কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন। প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ অ্যাপও সাহায্য করতে পারে।
ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করুন
গন্তব্যের দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকা তৈরি করুন এবং সে অনুযায়ী দৈনিক পরিকল্পনা সাজান। এটি আপনাকে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে সাহায্য করবে।তবে খুব চাপমুক্ত ভ্রমণের জন্য অতিরিক্ত পরিকল্পনা করবেন না। মাঝে কিছুটা অবসর রাখুন যাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারেন।
নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিন
নতুন দেশে সবসময় সতর্ক থাকুন। আপনার মূল্যবান সামগ্রী যেমন পাসপোর্ট, টাকা, এবং ফোন নিরাপদে রাখুন। কোনো স্থানীয় সমস্যা বা প্রতারণা এড়ানোর জন্য আগে থেকেই সচেতন থাকুন।
নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন
বিদেশে ভ্রমণের সময় স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হলে পুরো যাত্রা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যথেষ্ট বিশ্রাম নিন এবং পরিচ্ছন্ন খাবার ও পানি খান।
সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন
নতুন দেশে ভ্রমণের সময় সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি এবং প্রথাগুলোকে সম্মান করুন। কিছু সাধারণ শব্দ বা বাক্য যেমন ধন্যবাদ, অনুগ্রহ করে—স্থানীয় ভাষায় শিখে নিন। এটি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করে তুলবে।
জরুরি নম্বর সংরক্ষণ করুন
আপনার দেশের দূতাবাস, স্থানীয় পুলিশ, এবং হাসপাতালের জরুরি নম্বরগুলো সংরক্ষণ করুন। এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কাজে আসতে পারে।
ছবি তুলুন, কিন্তু উপভোগ করতেও ভুলবেন না
বিদেশ ভ্রমণ মানে শুধুমাত্র ছবি তোলা নয়। আপনার আশেপাশের পরিবেশ উপভোগ করুন, নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলুন এবং স্মৃতি তৈরি করুন।
ফেরার প্রস্তুতি
বিদেশ ভ্রমণের শেষে সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করুন। শপিং বা স্থানীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য একটু সময় বের করে নিন।
প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ অনেক আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক হতে পারে যদি আপনি সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেন। তাই উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করে আত্মবিশ্বাসীভাবে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ুন। আপনার যাত্রা সফল এবং স্মরণীয় হোক।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।