ছিদ্দিক ফারুক: ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল প্রথমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে এটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দেশের কৃষক, শ্রমিক-জনতা, চাকরিজীবী, আলেম সমাজ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শাহাদাত নতুনভাবে মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। একই দিনে ছয়জন শহীদ হন। এ খবর সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হল ছাড়া করে শিক্ষার্থীরা।
১৭ জুলাই বিকেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য হল ও ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে অনেকে বাড়িতে, ঢাকা-শহরের আত্মীয়ের বাসা কিংবা মেসে ওঠে। আন্দোলন পুরোপুরি স্তিমিত হয়ে যাওয়ার সময় আবাবিলের মতো ছুটে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের অনেকে শহীদ হন, অসংখ্য আহতও হন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, অবস্থানগত, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে মতবিরোধ আছে। সেটা সামাজিক মাধ্যম, আড্ডায় কিংবা গল্পে আমরা দেখি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রথম দিকে কোন মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন করেনি, তারা শিক্ষার্থীদের রক্ত দেখে মাঠে নেমে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, সকল স্তরের মানুষ নেমে পড়ে।
২০ জুলাই ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সমন্বয়ক আবদুল কাদের ৯ দফা ঘোষণা করেন। ৯ দফাকে সমর্থন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন মাঠপর্যায়ে শক্ত ভূমিকা রাখে। কমপ্লিট শাটডাউনের সময় ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। এভাবে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৩ আগস্ট ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ, নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ সেদিন জমায়েত হয় শহীদ মিনারে। শহীদের রক্তের বদলা নিতে সেদিন যেন সবাই শপথবদ্ধ। জনস্রোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, শাহবাগে লোকে লোকারণ্যে ভরপুর। পরদিন ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। এবার কোনো কোটা সংস্কার নয়, সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলন। সারাদিন নানা গুজব, মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য ছবি, ভিডিও কিংবা লেখা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়, মনোবল শক্ত করে, গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
আজ এমন একটি ছবির কথা বলব– আমি তখন দৈনিক আজকের পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। সারাদিনের সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার পর টিএসসির অতিথি কক্ষে রাতে বিশ্রাম নিতে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা টিএসসির অতিথি কক্ষে অবস্থান করে সারাদেশের মানুষের কাছে সঠিক সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেছে, এটা নিয়ে বেশ আলোচনা নেই।
বিশ্রাম নিতে গিয়ে সামাজিক মাধ্যম স্ক্রল করতে দেখি নানা গুজবে ভরপুর করে রেখেছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সমর্থিত অ্যাক্টিভিস্টরা। তার মধ্যে একটি গুজব ছিল এমন– সারাদেশ থেকে লাখ লাখ আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী রাজু ভাস্কর্য, টিএসসি ও শাহবাগে একত্র হয়েছেন। অথচ কোনো মানুষ সেদিন রাতে ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পিনপতন নীরবতা চলছে। সামাজিক মাধ্যমের গুজবকে ডিবাঙ্ক করার জন্য আমরা একটি ছবি তোলার উদ্যোগ নিই।
দৈনিক সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, আমার বিভাগের জুনিয়র যোবায়ের আহমদের পরামর্শে এ ছবি তুলি। ছবিতে আমি (ছিদ্দিক ফারুক), যোবায়ের, দৈনিক নয়া দিগন্তের হাসান আলী, আমাদের সময়ের আশিকুল হক রিফাত, ইত্তেফাকের নেসার উদ্দিন ও ডেইলি মেসেঞ্জারের মাহমুদ নকীব। ছবি তুলেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের জোবায়ের হোসেন।
ছবি তোলার পর আমার নিজস্ব ফেসবুক আইডি থেকে শেয়ার করি। শেয়ার করে বলি– টিএসসিতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। শেয়ার করার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাক্টচেকাররা এ ছবি ব্যবহার করে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের ছড়ানো গুজব ডিবাঙ্ক করে ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। আমাদের ছবির বরাতে সমন্বয়করা সব স্তরের মানুষকে ভয় না পেয়ে রাস্তায় নেমে আসার ঘোষণা দেয়। ফেসবুকে এ ছবি দেওয়ার পর নানাজনের কাছ থেকে ধন্যবাদ পেলেও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছি।
পরদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ নেমে আসে। মানুষের মনোবল জোগাতে এ ছবি একটি মাইলফলক– এটি গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার সবাই স্বীকার করেন। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক, অংশগ্রহণকারীরা দেখা হলে এ ছবির প্রশংসা করেন। নিজদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প বলেন। শুধু এ ছবি নয়, অনেক ছবি-গল্প-ভিডিও এ গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণতা দিয়েছে। আমাদের ছবিও তেমন একটি বাক বদলে ভূমিকা রেখেছে।
ছিদ্দিক ফারুক: গবেষক, গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণ বিভাগ, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত