Untitled 1 copy 18 2

এমটিএফই স্ক্যাম : অর্থনীতির ইতিহাস কলঙ্কিত করা ‘পিরামিড’ ব্যবসা বাংলাদেশে কেন?

print news

আলী আহমাদ রুশদী :

স্টাডি রুমে বসে অনেকক্ষণ জানালার ওপাশে ফিরোজা গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ঠিক কী দেখছিলাম তা আর এখন মনে করতে পারছি না। হঠাৎ বুলবুল (আমার স্ত্রী) ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী চিন্তা করছ অমন আনমনা হয়ে? আমি বললাম না, তেমন কিছু নয়। ভাবছিলাম পিরামিড সেলিং কেন নিষিদ্ধ। বিষয়টি নিয়ে ভাবছি ঠিকই, তবে মন লাগাতে পারছি না। বুলবুল জিজ্ঞেস করল মিসরের পিরামিড বিক্রি হবে? আমি বললাম মিসরের পিরামিড কে বিক্রি করবে আর কেইবা কিনবে। বুলবুল বলল, তবে কী? আমি বললাম মিসরের যে পিরামিড তা বিক্রি করা যে কোনো দেশেই নিষিদ্ধ। কারণ এসব পিরামিড ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত, যা কখনও বিক্রি করা যায় না। আমি যেই পিরামিড সেলিংয়ের কথা ভাবছি তাও অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে নিষিদ্ধ। তবে এই পিরামিড সেই পিরামিড নয়।

শুক্রবার রাতে খবর পেলাম বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে এক পিরামিড হাওয়া হয়ে গেছে। বুলবুল আবার প্রশ্ন করল, পিরামিড আবার টাকা নেয় কীভাবে; আর হাওয়া হয়ে যায় কীভাবে? তাকে ঘটনা বুঝিয়ে বললাম। এমটিএফই নামের পিরামিড স্কিমের এমএলএম কোম্পানি। সেটা আবার অনলাইনভিত্তিক। একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ছাড়া কিছুই নেই তাদের। এতক্ষণে বুলবুল বুঝতে পারল ঘটনা। স্ত্রীকে বোঝাতে আমার এত সময় লাগল। সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে এই পিরামিডের চালাকি।

একটি পিরামিডের কাঠামো যেমন ওপরের অংশ সরু এবং নিচের অংশ বিস্তৃত থাকে তেমনি পিরামিড সেলিংয়ের উপরাংশে একজন বা দুজন বিক্রেতা এবং তার নিচে স্তর অনুসারে পরিবেশক বা এজেন্টের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে পিরামিড সেলিংয়ের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। কোথাও কোথাও এই বাজার প্রক্রিয়ায় কোনো পণ্যই থাকে না। আবার কোথাও কোথাও বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অগণিত এজেন্সীর গুদামঘর বোঝাই করা হয়। পিরামিডের নিচের অংশে যারা থাকে তাদের পক্ষে কেনা দামেও এই পণ্য আর বিক্রি করা সম্ভব হয় না। অন্য দিকে যারা কোনো পণ্যই বিক্রি করে না তারাও এক সময় থামতে বাধ্য হয়। কারণ নতুন এজেন্ট পাওয়া না গেলে তহবিলে পয়সা আসাও বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পিরামিডের উপরি ভাগে যেসব এজেন্ট আছে তাদের বখরাও বন্ধ হয়ে যায়।

ধরা যাক একটি প্রতিষ্ঠান প্রথমে দশজন পরিবেশক নিয়োগ দেয় এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে জামানত হিসাবে দশ হাজার টাকা জমা রাখে। এই দশজনের প্রত্যেককেই একই শর্তে দশজন করে পরিবেশক জোগাড় করে দিতে হবে। নতুন পরিবেশকদের জামানতের টাকা থেকে তাদের উপরের স্তরের পরিবেশকরা হার মোতাবেক ‘লাভ’ পেতে থাকবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন পরিবেশক জুটতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। বেশ কিছু বেকার লোক একটা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার উপায় করতে পারছে ভালোই তো! কিন্তু এই ভালো কাজটা আর ভালো থাকবে না যখন আর নতুন পরিবেশক জুটানো সম্ভব হবে না। অঙ্কের অমোঘ নীতিতে প্রত্যেক স্তরে দশজন করে বাড়তে থাকলে দশম স্তরে পরিবেশকের সংখ্যা দাঁড়াবে দশ বিলিয়ন অথচ পৃথিবীর বর্তমান লোকসংখ্যা মাত্র সাত বিলিয়ন। কাজেই পিরামিড ব্যবসায়ের গোড়াতেই গলদ।

যে কোনো সফল ব্যবসায়ীকে অবশ্যই জানতে হবে কী পরিমাণ পণ্য তিনি বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। এই পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারিত হলে সর্বাধিক লাভ করা সম্ভব। সমস্যা হচ্ছে এই সঠিক পরিমাণটি আগে ভাগে জানবার কোনো উপায় নেই। কাজেই তাকে বেশ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। অর্থনীতিতে সঠিক পরিমাণকে বলা হয় ভারসাম্য পরিমাণ। জোগান যদি ভারসাম্য পরিমাণের তুলনায় কম হয় তাহলে লাভ কম হবে তবে বাজারে টিকে থাকার মতো সামর্থ্য তার থাকবে কিন্তু তিনি যদি ভারসাম্য পরিমাণের বহুগুণ বেশি বাজারজাত করার চেষ্টা করেন তাহলে মাঠে মারা যাবেন। বাজারে টিকে থাকার জন্য বাজারে যারা এলো ক্রেতা বা ভোক্তা (পরিবেশক কিংবা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা নয়) তাদের সঙ্গে জোগানদাতার যোগাযোগ থাকতে হবে। তারাই পণ্যের ভারসাম্যপূর্ণ পরিমাণ ঠিক করে দেবে।

যেসব পিরামিড ব্যবসায়ী জ্যামিতিক হারে এজেন্ট নিয়োগ করে তারা কখনই তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার দিকে তাকায় না। প্রকৃত পক্ষে তারা কোনো পণ্যের ব্যবসায়ী নয় বরং এজেন্টদের ঠকিয়ে লাভ করার চেষ্টা করে। পরিণামে নিজেরা ধ্বংস হয় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইর ধ্বংস ডেকে আনে।

আরও পড়ুন………………….

এমএলএম এমটিএফই বন্ধ, বাংলাদেশ থেকে চলে গেলো কয়েক হাজার কোটি টাকা

 

বিষয়টা সহজ করার জন্য আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দিলাম। ১৯২০ সালে চার্লস পঞ্জি নামে এক ইতালিয়ান-মার্কিনি আন্তর্জাতিক পোস্টাল কুপনের ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সময় চিঠির জবাব দেওয়ার সুবিধার্থে চিঠির সঙ্গে রিপ্লাই কুপন দিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। যে দেশে কুপন কেনা হতো সে দেশের ডাকটিকিটের সমান ছিল কুপনের দাম। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো দেশে কুপনগুলো সেই দেশের ডাকটিকেটের সঙ্গে বিনিময় করা যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য অনেক দেশের মতো ইতালিতেও মার্কিন ডলারের তুলনায় লিরার মুদ্রামান অতি দ্রুত কমতে থাকে। ফলে ইতালি থেকে কুপন কিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডাক টিকিটের সঙ্গে বিনিময় করলে যথেষ্ট লাভ থাকত। পঞ্জির কথানুসারে (অনেক বাড়িয়ে মিথ্যা করে বলেছিলেন) এসব বিনিময়ে লাভের পরিমাণ ছিল শতকরা ৪০০ ভাগ।

পঞ্জি অপেক্ষাকৃত কম দামে কুপন কিনে বেশি দামে বিক্রি করতেন। এই ব্যবসায় তার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু কিছু দিন ব্যবসা চালানোর পর দেখা গেল খরচ বাদ দিয়ে তার যে লাভ থাকে তাতে খুব দ্রুত অনেক টাকার মালিক হওয়া সম্ভব না। কাজেই তিনি তার ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করলেন। প্রথমে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে শুরু হলো। প্রতি নব্বই দিনে শতভাগ লাভের আশ্বাস দিলেন পঞ্জি। এই অতি মুনাফার লোভে প্রথমে কিছু লোক তার ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে রাজি হলো এবং কথা অনুসারে উচ্চহারে লাভও পেতে শুরু করল। কথায় কথায় এই কথা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল এবং আরও বেশি সংখ্যায় নতুন বিনিয়োগকারী পঞ্জির ব্যবসায় যোগ দিতে শুরু করল। নতুন লগ্নিকারকদের টাকা থেকে পুরাতন লগ্নিকারকদের উচ্চহারে লাভ দেওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই পঞ্জি কোটি পতি হয়ে গেলেন এবং বিলাসবহুল জীবন কাটাতে লাগল।

পঞ্জি তার ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য উচ্চহারে কমিশন দিয়ে এজেন্ট নিয়োগ করলেন এবং সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। অতি মুনাফার লোভে মানুষ দল বেঁধে তার কোম্পানিতে টাকা রাখা শুরু করল। পঞ্জি এসব টাকা হ্যানোভার ট্রাস্ট ব্যাংক নামে একটি ছোট ব্যাংকে জমা রাখতেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি তিন মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ওই ব্যাংকের একজন প্রভাবশালী মালিক বনে যান। সাধারণ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি বিক্রি করে ঘটিবাটি বন্ধক রেখে পঞ্জির ব্যাংকে টাকা জমাতে থাকে। পঞ্জি নিজে তার অপরিমিত টাকা হ্যানোভার ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন নামিদামি ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করলেন। নিজের জন্য আলিশান বাড়ি ও জীবন উপভোগ করার যাবতীয় সরঞ্জাম কিনলেন। এমনকি সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য বড় অঙ্কের টাকা দান করাও শুরু করলেন।

পঞ্জির বিলাসবহুল জীবন দেখে অনেকেই সন্দেহ করা শুরু করে এত টাকা কোত্থেকে আসে।

প্রথম প্রশ্ন আসে পঞ্জির নিজের ব্যবসা যদি এতই লাভজনক তাহলে তিনি নিজের ব্যবসায় আরও টাকা খাটাচ্ছেন না কেন। কিন্তু বোস্টনের এক সাংবাদিক এ বিষয়ে লেখালেখি করায় পাঁচ লাখ ডলারের মানহানীর মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ের নিয়মানুসারে কারও বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তা প্রমাণের দায়িত্ব ছিল লেখকের এবং যে পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছে তার মালিকের ওপর। এই সাংবাদিকের হাতে পঞ্জির বিরুদ্ধে বেআইনি কাজ কর্মের তেমন কোনো অকাট্য দলিল ছিল না। কাজেই মামলায় তিনি হেরে যান।। ফলে কিছুদিনের জন্য পঞ্জির বিরুদ্ধে লেখালেখিতে অনেকটা ভাটা পড়ে যায়। তবে মাঝে মাঝেই তার বিরুদ্ধে সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই পঞ্জি তার আর্থিক সামর্থ্যের জোরে বিশেষ করে হ্যানোভার ব্যাংক থেকে নীতিবহির্ভূতভাবে টাকা ‘ধার’ করে তার অর্থনৈতিক পতন কিছু সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন………………….

এমটিএফই প্রতারণা ॥ বরিশাল হারালো ১০ কোটিরও বেশি টাকা

সাংবাদিকরা খোঁজাখুঁজি করে বের করেছিল যে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানিতে লেনদেনের যে পরিমাণ তা সত্য হলে বাজারে কমপক্ষে ১৬০ মিলিয়ন পোস্টাল কুপনের থাকা দরকার। অথচ বাজারে বিদ্যমান কুপনের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭ হাজার। এই ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি তদন্তকারীদের নজর পড়ে পঞ্জির ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ কোম্পানির ওপর। তদন্তে অনেক গোলমাল ও গরমিল ধরা পড়ে।

পঞ্জির বাকি জীবন মোটেই সুখের ছিল না। জেলের ভেতরে-বাইরে বহু বছর কাটিয়ে অবশেষে ব্রাজিলে ভয়ানক দরিদ্র অবস্থায় মারা যান ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে। পঞ্জির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরেও পঞ্জি স্কিম বেঁচে আছে এখনও। আইনের ফাঁক পেলেই কিংবা আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে অনেকেই এখনও পঞ্জির অনুকরণে রামের টাকা দিয়ে রহিমকে বিদায় করার চেষ্টা করছে।

পঞ্জির গল্প শুনে বুলবুল বলল তোমার গল্পতো বড় সরস গল্প দেখি। আমি বললাম আরেকটা শুনবে? বলল শুনাও দেখি। আমি বললাম তবে শোনো।

১৯৬০ সালে সাবেক নাসডাক (NASDAC) চেয়ারম্যান বার্নাড ম্যাডফ ওয়াল স্ট্রিটে ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিস নামে তার ব্যবসা শুরু করেন। স্টক মার্কেটের ডিভিডেন্ড কিংবা ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি হারে লাভ দিতেন ম্যাডফ। স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কোম্পানির ডিভিডেন্ড নির্ভর করে সে কোম্পানির অর্জিত লাভের ওপর। কাজেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিবছর একই হারে ডিভিডেন্ড আশা করতে পারে না। কিন্তু ম্যাডফ তার বিনিয়োগকারীদের প্রতিবছরই উচ্চহারে লাভ দিয়ে যাচ্ছিলেন (প্রায় ২০ শতাংশ)। এমনকি ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে যখন সারা বিশ্বের শেয়ার মার্কেটে অস্বাভাবিক দর পতন ঘটেছিল তখনও ম্যাডফ তার শেয়ার হোল্ডারদের শতকরা ছয় ভাগ লাভ দিয়েছেন। পরে অনুসন্ধানে ধরা পড়ে এ সবই সম্ভব হয়েছিল ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারীদের অর্থের বদৌলতে, কোনো সত্যিকারের লাভজনক ব্যবসায়ের মাধ্যমে নয়। শেয়ার বেচাকেনা ছাড়াও ম্যাডফের সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে আরেকটি শাখা ছিল। এই শাখার অধীন ম্যাডফ অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নেন। তদানিন্তন আইন অনুসারে কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান বছরে কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ দান করতে হতো। ম্যাডফ দেখলেন শতকরা পাঁচ ভাগ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান কদাচিৎ টাকা উঠাতে আসে। তার মানে প্রতি বিলিয়ন ডলারের জন্য বছরে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার হাতে রাখলেই হলো। কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই বিশ বছর পর্যন্ত চলতে পারে এভাবে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বহু ফান্ড ম্যানেজারকে ম্যাডফ কমিশন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন। ফলে তার ফান্ডের গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। পঞ্জির মতোই ম্যাডফ কোনো সার্ভিস কিংবা উৎপাদনশীল কাজে অর্থায়ন না করেও গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের লাভ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।

অপরিমিত অর্থের মালিক হওয়ার পেছনে শেয়ার মার্কেটে বেচা-কেনা সম্পাদনের জন্য ম্যাডফের ব্যবহৃত অত্যাধুনিক টেকনোলজিও অনেকাংশে সহায়তা করেছে। কম্পিউটারভিত্তিক এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ম্যাডফ একদিনেই এত বেশি শেয়ার হাত বদলের কাজ করতে পারতেন—যা করতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দুই তিন দিন সময় লেগে যেত। ম্যাডফ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের ডলারে এক সেন্টের বিনিময়ে তাদের বেচা-কেনার কাজও করে দিতেন। বেশ সস্তায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দেওয়ার জন্য সবাই খুশি ছিল ম্যাডফের ওপর। তাহলে অসুবিধা কোথায়? সাংবাদিকদের নিরলস চেষ্টায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসে কিছু দিনের মধ্যেই।

ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিস এবং অন্যান্য সিকিউরিটিস কোম্পানির যারা ম্যাডফের মাধ্যমে বেচা-কেনা করে তাদের অর্ডারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ম্যাডফ আঁচ করতে পারতেন কোনো শেয়ারের দাম দুই এক দিনের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে না হ্রাস পাবে। সাধারণ ক্রেতাদের তুলনায় বাজারের সামগ্রিক চিত্রটি ম্যাডফের চোখে আগেই ধরা পড়ত। এ ব্যাপারে যত বেশি গ্রাহক ম্যাডফের মাধ্যমে অর্ডার দিত ম্যাডফের পূর্বাভাস ততই বেশি বাস্তবভিত্তিক হতো। এই অবস্থায় ম্যাডফ অন্যদের আগেই শেয়ার কিনে লাভবান হতেন কিংবা বিক্রি করে দিয়ে লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে পারতেন। শেয়ার মার্কেটের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় ফ্রন্ট রানিং বা ইনসাইডারস বিজনেস যা প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ কিন্তু প্রমাণ করা বড় কঠিন।

বেশুমার অর্থের মালিক ম্যাডফ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ধরা পড়েন এবং ২০০৯ সালে জুন মাসে ফেডারেল কোর্ট তাকে ১৭ বিলিয়ন ডলার জরিমানাসহ ১৫০ বছরের কারাদণ্ড দেয়।

ধরা যাক ম্যাডফ ধরা পড়েননি এবং তার কোনো শাস্তিও হয়নি। তাহলে কত দিন ধরে তিনি তার ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতেন? খুব বেশি দিন নয়। কারণ চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতার কারণে এক সময় তার পক্ষে সবদিক সামাল দেওয়া সম্ভব হতো না এবং প্রকৃত বিনিময় তথা প্রকৃত উপার্জন না করেও রাজার হালে চলা সম্ভব হতো না। বস্তুত, ২০০৫ সাল থেকেই ম্যাডফ প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন অ্যাসেটের পরিমাণ মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে তখন ম্যাডফ তার দুই ছেলে মার্ক ও এন্ড্রুর কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের ১৭০ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম বোনাস দেওয়া হোক। সন্তানরা জানতে চায়—যেখানে টাকার অভাবে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না, সেখানে বোনাসের কথা আসে কী করে? ম্যাডফ স্বীকার করেন তার সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটটি ছিল ‘one big lie.’ পঞ্জি স্কিমের একটি আধুনিক সংস্করণ।
পিরামিড ব্যবসায়ের আরও অনেক অবাঞ্ছিত কাহিনি অর্থনীতির ইতিহাস কলঙ্কিত করে আসছে। আমি শুধু দুটি মাত্র কাহিনি তুলে ধরলাম পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।

আলী আহমাদ রুশদী : প্রবাসী অর্থনীতিবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন....

Check Also

MlUUzyJ5HkNwSq1laPEgspMb05GowIhDm0TDfQlO

উদ্দীপ্ত কৈশোর বনাম কিশোর গ্যাং

 রুমা মোদক : কিশোর গ্যাং শব্দটির সঙ্গে ঠিক কবে পরিচয় ঘটেছিল? খেলার সাথি, গলাগলি কিংবা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *