Plate for Songbad Prokash 20 20220730031519

সাংবাদিকতা: কী পড়াই আর কী পাই?

print news

শিবলী নোমান: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার সঙ্গে চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় সধারণ একটি প্রবণতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই যে বক্তব্য কিংবা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, সেই অভিজ্ঞতাটি হলো শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সঙ্গে চাকরিক্ষেত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগের পার্থক্যবিষয়ক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানকৃত অন্যান্য বিষয়ের মতো সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিষয়ে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীরাও এই বিষয়টির মুখোমুখি হন, যার হার তুলনামূলকাভবে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি, মোটাদাগে এমনটা বলার সুযোগ রয়েছে। কারণ, দেশের সাংবাদিকতার জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের থেকে একটি গল্প শোনার অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই হয়ে থাকতে পারে। সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক/স্নাতকোত্তর সনদধারীদের উদ্দেশ করে দেশের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের ভাষ্য অনেকটা এমন যে—যারা অন্য বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে সাংবাদিকতায় আসে, তাদের সাংবাদিকতাটা শিখিয়ে নিলেই হয়। কিন্তু সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ালেখা করে আসা সাংবাদিকদের আগে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাটা ভোলাতে হয়, তারপর সাংবাদিকতা শেখাতে হয়। উক্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, তবে সংবাদ জগতে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত সাংবাদিক ছিলেন।

বিষয়টা কিন্তু এমন নয় যে, আলোচ্য জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এমন ধারণা পোষণ করে খুব বড় ভুল করতেন। এটি অবশ্যই স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, যেকোনো বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় বিভিন্ন ব্যবহারিক পরিস্থিতির আলোকে গৃহীত পন্থা ও উদ্ভূত তত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানোর চেষ্টা করা হয়। আবার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিস্থিতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মপন্থাও অবলম্বন করতে হয়। ফলে অতীতের কর্মপন্থা কিংবা তা থেকে উদ্ভূত জ্ঞান যে ধ্রুব সত্য হিসেবে সব পরিস্থিতি, সময়ে ব্যবহার ও প্রয়োগযোগ্য হবে, তা কোনোভাবেই হওয়ার নয়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমরা সাধারণত ভুলে থাকতে চাই, তা হলো শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক শিক্ষা ও বাস্তব ক্ষেত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগের ভেতর একধরনের যোগাযোগ, সমন্বয় ও চিন্তার চলাচল না থাকলে দুটি বিষয় যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তেমনি এ বিচ্ছিন্নতার মারাত্মক ফলাফল হিসেবে অত্যন্ত সম্পর্কিত এই দুটি বিষয়ের ভেতর সামঞ্জস্যের অভাবও দেখা দেয় প্রকটভাবে।

অন্যদিকে নিজের পড়ালেখার সঙ্গে পেশাগত চর্চায় অমিলের ঘটনার পেছনে যেখানে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিরই মূল অনুঘটক হওয়ার কথা, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতায় সেটি যে খুব একটা দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু না। বরং সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতার একদম মৌলিক বিষয় হিসেবে শ্রেণিকক্ষে যা শেখানো হয়, সেগুলোর বিপরীত বা ভুল চর্চা করতে প্রায়ই তারা বাধ্য হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। অথচ এগুলো সাংবাদিকতার একেবারে ভিত্তিস্বরূপ, সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ালেখার সনদ না থাকলেও পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেওয়া প্রত্যেক মানুষেরই এই বিষয়গুলো জানার ও চর্চা করার কথা। বিষয়টি নিয়ে বিদ্যায়তনিক গবেষণা যেমন হতে পারে, আবার এমন কয়েকটি চর্চার দিকে বর্তমান লেখাটিও আলোকপাত করতে পারে।

আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগসমূহের পাঠ্যক্রমের বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী, সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ালেখা শেষ করুক বা না করুক, একজন শিক্ষার্থী যদি স্নাতক প্রথম বর্ষে তিন মাসের জন্যও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ালেখা করেন, তিনি জেনে যাবেন একটি ঘটনার কোন বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তা নিছক ঘটনা থেকে প্রকাশযোগ্য সংবাদ হয়ে ওঠে। সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে চর্বিত-চর্বন এসব বৈশিষ্ট্যের যতগুলো একটি ঘটনায় উপস্থিত থাকে, সেই ঘটনাটির সংবাদ হয়ে ওঠার যোগ্যতা কিংবা সংবাদমূল্য তত বেশি।

কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম প্রবণতা হলো সংবাদমূল্য থাকুক বা না থাকুক, কতিপয় বিশেষ গোষ্ঠীর যেকোনো কর্মকাণ্ডকে সংবাদ আকারে প্রকাশ করা। এ কারণেই দেখা যায় গণমাধ্যমের মালিক গোষ্ঠীর ফাস্ট ফুড ব্যবসার অংশ হিসেবে ওই ফাস্ট ফুডের ৭০তম দোকান উদ্বোধনের সংবাদ টেলিভিশন চ্যানেলের প্রাইম টাইম বুলেটিনে ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। এভাবে গণমাধ্যমটির মালিক শ্রেণির অপরাপর ব্যবসার বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ, যেমন একই মালিকানায় থাকা ব্যাংকের নতুন শাখা উদ্বোধন, নিজেদের অর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো কিংবা নিজেদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অতিরিক্ত ফলাও করে প্রচারের মতো ঘটনাগুলো নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে।

আবার, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপন দেওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে একধরনের তোয়াজ করেও চলতে হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। এ ক্ষেত্রেও সংবাদমূল্যহীন কিন্তু বিজ্ঞাপন দেয় এই যোগ্যতায় নানাবিধ সংবাদ হওয়ার অযোগ্য ঘটনা বারবার সংবাদ হয়ে শ্রোতা-পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় সংবাদকর্মীদের। একই সঙ্গে না চাইলেও গোপন করতে হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি, খাদ্যে ভেজাল কিংবা এরূপ অপকর্ম-দুর্নীতির জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য।

অর্থাৎ খুব সাধারণ যে সংবাদজ্ঞান বা নিউজ সেন্সের কথা শ্রেণিকক্ষে বারবার শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়, বোঝানো হয়, আত্মস্থ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরুর একেবারে প্রথম দিকেই সেই মৌলিক জ্ঞানটি সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এর মাধ্যমে যে ভয়াবহ ঘটনাটি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে ঘটে তা হলো, পেশাগত সাংবাদিকতার প্রথম থেকেই গণমাধ্যমকে তারা আর গণমানুষের মাধ্যম মনে করে না। ফলে প্রথাগত সাংবাদিকতার শিক্ষা তার কাছ অপ্রয়োজনীয় ও ইউটোপিয়ান মনে হয়।

সংবাদমূল্যের সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয় হলো সংবাদের শিরোনামের হাল-চাল। যেখানে সংবাদমূল্য ও সংবাদের শিরোনাম নিয়ে একাধিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুইয়ের অধিক কোর্স পড়ানো হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে, সেখানে কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শুধু সংবাদমূল্যহীন সংবাদ প্রকাশেই বাধ্য করা হচ্ছে না, তাদেরকে এমন মুখরোচক শিরোনাম প্রদানের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে, যা দেখেই পাঠক সেই সংবাদে ক্লিক করে মুনাফা নিয়ে আসবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানিটির জন্য। সে ক্ষেত্রে সে শিরোনামে উল্লেখ করা তথ্যটি সত্য হোক বা মিথ্যা, সংবাদে থাকুক বা না থাকুক, কিংবা হোক না রেইসিস্ট বা সেক্সিস্ট, তাতে কার কি!

এ ছাড়া সংবাদে সূত্রের নাম প্রকাশ করা বা না করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুসরণের ক্ষেত্রেও নানাবিধ চর্চা চোখে পড়ে। যেখানে মানসম্মত চর্চা হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ এমন সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশকে নিরুৎসাহিত করছে, এবং শ্রেণিকক্ষেও এটিই বলা হচ্ছে, আর জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে একজন সংবাদকর্মী এমন সূত্রের উল্লেখ করে তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন ও সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোন তথ্যগুলো তাকে উল্লেখ করতে হবে, সেখানে নিয়মিত ভিত্তিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেই মানগুলো নিশ্চিত না করেই ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ সূত্রের ব্যবহার চোখে পড়ে। এর বাইরে ‘অসমর্থিত সূত্র’, ‘অনুসন্ধানে জানা যায়’, ‘সংশ্লিষ্টদের মতে’ প্রভৃতির মতো ভুতুড়ে সূত্রের উল্লেখ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি?

অথচ যেসব বড় বড় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আসলে নিরপেক্ষতা ও জনগণের স্থলে নিজস্ব ও নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে, তারাও তাদের সংবাদে এসব মৌলিক নীতিগুলো আপাতদৃষ্টে অনুসরণ করে এবং অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কাজের মাধ্যমে সংবাদকর্মীরা আসলে এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী সাংবাদিকও হতে পারেন না, তাকে হতে হয় তল্পিবাহক তথ্য প্রচারকারী মাত্র।

এগুলো বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের সাংবাদিকতার খুব সাধারণ চর্চা। এর সঙ্গে আরও অনেক জটিল কিন্তু সম্পর্কিত বিষয় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেশাগত সাংবাদিকতা চর্চাকে দিনকে দিন শ্রেণিকক্ষে সাংবাদিকতার তাত্ত্বিক পাঠ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। আর এই দূরত্বের সঙ্গে নতুন সংবাদকর্মীদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকরা যে বটিকা ব্যবহার করে আসছেন তা হলো, শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা আর বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। অর্থাৎ তারা সামনে তুলে ধরছেন তত্ত্ব বনাম চর্চার একটি ডিসকোর্স।

এটি সত্য যে এখানে একটি ডিসকোর্স অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটি তত্ত্ব বনাম চর্চার নয়। সংবাদের পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি খেয়াল করলে খুব সহজেই ধরা পড়বে যে, সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক ও ধ্রুব ধরে নেওয়া যেসব চর্চা ও নীতিমালা বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, তার ফলে কোনো না কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক বা সাম্প্রদায়িক মুনাফা তৈরি হচ্ছে। আর সেই মুনাফা তৈরি জারি রাখতেই সাংবাদিকতার নামে তল্পিবাহক এবং সংবাদের নামে নিজ স্বার্থে তথ্য বা অপতথ্য প্রকাশ করতে হয়, আর এগুলোকে বৈধ করার জন্য সংবাদকর্মীদের সামনে নিয়ে আসা হয় তত্ত্ব বনাম চর্চার ডিসকোর্সকে। যেখানে আদতে ডিসকোর্সটি হওয়ার কথা তত্ত্ব বনাম মুনাফার। অথচ পুঁজির জোরে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে, কী আজব প্যারাডক্স!

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....

Check Also

109104 milton

মিল্টন সমাদ্দারের ভেতর-বাহির

বদরুল হুদা সোহেল : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতির কবি হিসেবে খ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ‘লন্ডন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *