ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : এজেন্ট কমিশন, ইনসেন্টিভ ও অ্যালাউন্সের নামে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স’রর তহবিল থেকে ৭শ’ ১৮ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এ আত্মসাতে ব্যবহার করা হয়েছে অন্তত:২ হাজার ১০০ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ ৬ বছরে আর্থিক খাতে নৈরাজ্যের সুযোগে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে এ অর্থ। এর মধ্যে ২০১২-২০১৪ সালে ৩শ’ কোটি টাকা এবং ২০১৮-২০২০ সালে ৪১৭ কোটি টাকা নগদ হাতিয়ে নেয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)র তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে এসব তথ্য।
তদন্তকালীন রেকর্ডপত্র বলছে, বেতন-ভাতাসহ কমিশনের টাকা নগদ লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ২০১২ সালে-ই সার্কুলার জারি করে বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা-আইডিআরএ। কর্তৃপক্ষের এ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর এজেন্ট কমিশনসহ ইনসেন্টিভ ও অ্যালাউয়েন্সের অর্থ নগদ লেনদেন করে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি (এনএলআইসি) তৎকালিন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে স্বল্প আয়ের বীমা এজেন্টরা ব্যাংক হিসাব খুলে ন্যূনতম কমিশন গ্রহণে আগ্রহী নন। তাই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। কোম্পানির ব্যবসা সচল রাখার জন্য এজেন্ট কমিশনসহ ইনসেনটিভ ও অ্যালাউয়েন্সের টাকা সংশ্লিষ্ট জোন অফিস থেকে মাঠকর্মীদের নগদে পরিশোধ করা হয়েছে।
ভুয়া ভাউচারে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ স্থানান্তর, হস্তান্তর তথা মানিলন্ডারিংয়ের এ চিত্র ধরা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলার তদন্তে। গত ৪ মে সংস্থাটির উপ-পরিচালক শেখ গোলাম মাওলা মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আওয়ামী সরকারের সাবেক এমপি মোরশেদ আলম, তার ভাই ও এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন, মোরশেদ আলমের ছেলে ‘বেঙ্গল কনসেপ্ট অ্যান্ড হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলমকে আসামি করা হয়। গ্রাহকের অর্থে প্রকৃত মূল্য গোপন করে অস্বাভাবিক মূল্যে ন্যাশনাল লাইফের নামে সম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৬ হাজার ১৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় মামলা। তবে মামলাটির তদন্তে বেরিয়ে আসছে কেঁচো খুড়তে সাপ।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো: আকতার হোসেন বলেন, অস্বাভাবিক মূল্যে সম্পত্তি ক্রয়, বিভিন্ন ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ন্যাশনাল লাইফ থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের প্রমাণাদি মিলছে তদন্তে। তদন্ত কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির বহু রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন। প্রাথমিক এজাহারে তিন জনের সম্পৃক্ততার উল্লেখ থাকলেও রেকর্ডপত্রে মোরশেদ আলম নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালনা পরিষদের অন্যান্য সদস্যের সম্পৃক্ততা মিলছে। ফলে তদন্ত প্রতিবেদনে আরও কিছু ধারা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
এদিকে তদন্তে প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ওপর একটি বিশেষ অডিট পরিচালনা করে। ২০১২-২০১৪ সালের ব্যবসার ওপর ‘হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং’ এবং ২০১৮-২০২০ সালে ওপর ‘একনাবিন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস’ এ অডিট পরিচালনা করে। অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, কোম্পানিটি মাত্র তিন বছরে কমিশন, ইনসেন্টিভ ও অ্যালাউন্স বাবদ উত্তোলন করে ৪শ’ ১৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এটি শুধু বীমা আইনেরই লঙ্ঘন নয়-সুষ্পষ্টই জালিয়াতি, প্রতারণা, আত্মসাৎ এবং মানিলন্ডারিং আইনেরও গুরুতর লঙ্ঘন।
অডিটের তথ্য মতে, ২০২০ সালে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য ১৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা নগদ পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বছর কমিশন বাবদ কথিত এজেন্টদের শোধ করা হয়েছে ৮৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ব্রাঞ্চ কো-অডিনেটর ও ডিস্ট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটরদের কমিশন ও অ্যালাউয়েন্স ‘পরিশোধ’ দেখানো হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য কমিশন বাবদ ১৪৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা নগদ পরিশোধ করে কোম্পানিটি। এর মধ্যে প্রথম বছর কমিশন ও ইনসেন্টিভ পরিশোধ দেখানো হয় ৬৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ব্রাঞ্চ কো-অডিনেটর, ডিস্ট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটরদের কমিশন ও অ্যালাউন্স দেয়া হয় ৮০ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০১৮ সালে ‘এজেন্ট কমিশনৎ বাবদ ‘নগদে পরিশোধ’ দেখানো হয় ১শ’ ১৫ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বছর কমিশন ও ইনসেন্টিভ দেয়া হয়েছে ৬২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ব্রাঞ্চ কো-অডিনেটর, ডিস্ট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটরদের কমিশন ও অ্যালাউয়ন্স পরিশোধ দেখানো হয় ৫২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
‘হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং’ অডিট হয় ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের ওপর। এ তিন বছর ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা সংগ্রহের জন্য এজেন্ট কমিশন, অ্যালাউন্স, কমিশন ও ইনসেন্টিভ বাবদ নগদে পরিশোধ করেছে ৩শ’ কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে নগদের পরিশোধ করেছে ১০১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বর্ষ কমিশন ও ইনসেন্টিভ দেয়া হয় ৮৭ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ইউএম, বিএম ও ডিসি’দের কমিশন ও অ্যালউয়ন্স নগদ পরিশোধ করা হয় ১৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৩ সালে এনএলআইসি নগদ লেনদেন করে ১০৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বছর কমিশন ও ইনসেন্টিভ দেয়া হয় ৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ইউএম, বিএম ও ডিসি’দের কমিশন ও অ্যালাউন্স বাবদ নগদে পরিশোধ করা হয ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০১২ সালে কোম্পানিটি এজেন্ট কমিশন ও অ্যালাউন্স বাবদ ‘নগদ পরিশোধ’ করা হয় ৯১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বর্ষ কমিশন ও ইনসেন্টিভ দেয়া হয়েছে ৭৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ব্রাঞ্চ কো-অডিনেটর ও ডিস্ট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটরদের দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
এ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লেনদেনের কারণে এনএলআইসিকে তেমন কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। আইডিআর’র তার বীমা আইন-২০১০ এর ১৩০ ধারা অনুযায়ী নামমাত্র অর্থদণ্ড করেছে মাত্র। আর মধ্য দিয়ে এনএলআইসি’র কর্তাব্যক্তিদের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ,জালিয়াতি, প্রতারণা ও অর্থ পাচারের অপরাধকে আড়াল করা হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে সংঘঠিত অনিয়মের বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্সের মুখনির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাজিমউদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত