ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ:চোখের জলে স্মরণ সহপাঠীদের

image 210488
print news

অনলাইন ডেস্ক : রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে ক্যাম্পাসটি কয়েকদিন আগেও শিক্ষার্থীদের হাসি, উচ্ছ্বাস আর আড্ডায় থাকত প্রাণবন্ত, সেখানে এখন কেবলই শোক, নীরবতা আর দীর্ঘশ্বাস। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সহপাঠী-শিক্ষকদের হারিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা এখনো শোকে স্তব্ধ। ভয়াবহ সেই ঘটনার ১২ দিন পরও সবার চোখেমুখে হতাশা আর প্রিয়জন হারানোর বেদনা। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মুখেও বিষণ্নতার ছাপ। তবু তারা চেষ্টা করছেন কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে।

গতকাল রোববার সীমিত পরিসরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ খুললেও ছিল না চিরচেনা কোলাহল। কোনো ক্লাস হয়নি এদিন। তবে সকালে কয়েক ধাপে হয়েছে দোয়া মাহফিল ও স্মরণসভা। গত ২১ জুলাইয়ের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর গতকাল নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ডাকা হয় স্মরণসভায় অংশ নিতে। ডাকে সাড়া দিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়া শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে ছিল শোক আর বেদনার ছাপ।

সরেজমিন দেখা যায়, সকাল ১০টা থেকেই শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে শুরু করে। কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে বিধ্বস্ত ভবনের চারপাশে নীল টিন দিয়ে ঘেরা এলাকা। এ ভবনের শ্রেণিকক্ষেই ক্লাস করত নিহত শিক্ষার্থীদের অনেকে। মূল ফটক পেরিয়ে ডানদিকে ভবনটির পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অনেককে, যাদের কারও কারও চোখ থেকে নীরবে গড়িয়ে পড়ছিল জল। ফটকের সামনে ছোট এক ছাত্রীকে দেখা যায় তার মাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল—‘মা, আবার যদি কিছু হয়?’ আরেক কিশোরকে তখন দেখা যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার ভেঙে পড়া ক্লাসরুমের দিকে তাকিয়ে থাকতে।

বিধ্বস্ত ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন আল আমিন বলেন, ‘এখনো বিশ্বাস হয় না, এ ভবনটি এখন একটা বিধ্বস্ত কাঠামো। আমরা প্রতিদিন যেটাকে ভবিষ্যতের সিঁড়ি ভাবতাম, সেটা এখন স্মৃতির ভার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ আরেক শিক্ষার্থী রাইশা তাবাসসুম বলেন, ‘দীর্ঘদিন এ দুর্ঘটনার কথা আমাদের মনে গেঁথে থাকবে। সহপাঠীর মৃত্যু কখনো ভুলতে পারব না।’

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইরফাত আরা রাফাকে দেখা গেল স্কুলের ভবনের দিকে তাকিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়তে। মাকে আঁকড়ে ধরে বারবার সে বলছিল, ‘মা, চলো বাসায় চলে যাই। আমার ভয় লাগছে। আমি এখানে থাকব না।’

প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী হুমায়রার মা শারমিন আক্তার কাঁপা কাঁপা গলায়  বলেন, আজ মেয়েকে নিয়ে স্কুলে আসতে আমার বুক কেঁপে উঠছিল। সারারাত ঘুমাতে পারেনি ও। বারবার ঘুম ভেঙে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরছিল, বলছিল—আম্মু, আবার যদি স্কুলে আগুন লাগে?’

বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইশা আফরোজ বলেন, ‘এখনো বিমানের শব্দ শুনলেই গা শিউরে ওঠে। তবু আমি ক্লাসে ফিরতে চাই। কারণ ঘরে বসে থাকলে বারবার সেই দৃশ্যগুলোই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’

কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রঞ্জন কুমার অধিকারী বলেন, ‘ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রচণ্ড আতঙ্ক কাজ করছে। কেউ কেউ ফোন ধরছে না, স্কুলে আসতেও চাইছে না। তবে সংখ্যাটা কম। বেশিরভাগই বলছে, তারা দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চায়। আমরা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছি, মেডিকেল ক্যাম্প করেছি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করছি।’

পরে তিন ধাপে কলেজ অডিটোরিয়ামে হয় শোকসভা ও মিলাদ মাহফিল। সেখানে কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরু হয়ে শেষ হয় এক শোকাবহ পরিবেশে। স্মরণসভায় শিক্ষার্থীদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। অনেক শিক্ষকও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।

অনুষ্ঠানে কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, ‘এ দুর্ঘটনা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমরা শুধু শিক্ষার্থী হারাইনি, হারিয়েছি পরিবারের সদস্যদের।’ তিনি শিক্ষার্থীদের একে অপরের পাশে থাকার এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বন্ধুদের খোঁজ নেওয়ার আহ্বান জানান। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং দেওয়া হবে বলে জানান অধ্যক্ষ।

অনুষ্ঠানে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা কর্নেল (অব.) নুরুন নবী বলেন, ‘ট্রমা কাটাতে শিক্ষার্থীরা চাইলে মাইলস্টোনের যে কোনো শাখায় বদলি হতে পারবে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। অভিভাবকদের আমরা বলেছি, তাদের যেখানে খুশি, সেখানে নিয়ে যান। তবে এমন জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে তার বন্ধুবান্ধব আছে, যেন সে মানসিক স্বস্তি খুঁজে পায়। নতুন কোনো জায়গায় গেলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারে না। বরং পরিচিত পরিবেশ, বন্ধু মহল বা সার্কেল থাকলে তারা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে। এ কারণেই অন্য শাখায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পূর্বপরিচিতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’

কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনার ভয়াবহতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের ধীরে ধীরে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে কাজ করছে। এখনো নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়নি। আগামী ৬ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টা থেকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর পরবর্তী অবস্থা বিবেচনায় বাকি ক্লাসগুলো চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি আগামী তিন মাস শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে কাউন্সেলিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শ্রী কুমার টিটু বলেন, ‘এই ট্র্যাজেডি সহজে ভোলার নয়। শিক্ষার্থীদের মনে দাগ কেটে গেছে। তবে ধীরে ধীরে তারা স্বাভাবিক হচ্ছে। ঘটনার তিন দিনের মাথায় আমরা কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করি। প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা সেখানে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, তাদের এই সাহসের জোরে শিগগির সব আবার স্বাভাবিক হবে।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.