ইলিশের দাম বেশি,মৌসুম শুরু হলেও কমেনি দাম


বিবিসি বাংলা: বছরজুড়েই ইলিশ মাছের দাম অনেকটাই বেশি। সাধারণত ইলিশের দাম অন্যান্য মাছ বা খাদ্যপণ্যের চেয়ে বেশি হয়, কিন্তু এবারে যেন অনেকটা নাগালের বাইরেই চলে যাওয়ার উপক্রম।ইলিশের মৌসুম শুরু হলেও দাম কমেনি। কেন এই পরিস্থিতি? এবছর কি আদৌ দাম কমবে?
ইলিশের দাম কত?
কারোয়ান বাজারে এখন এক কেজির একটি ইলিশ মাছের দাম ২৫০০-২৬০০ টাকার মতো পড়ছে। এক কেজির বেশি ওজনের মাছ হলে সেটি ওজনভেদে প্রতি কেজি ৩০০০-৩৫০০ টাকাও দেখা যাচ্ছে।আর এক কেজির কম ওজনের মাছের ক্ষেত্রেও কেজিতে ২০০০ টাকার আশেপাশেই থাকছে।
পলাশী বাজারের একজন বিক্রেতা প্রদীপ রাজবংশী বলছিলেন যে, এক কেজির ইলিশ গত সপ্তাহেও ২০০০ টাকায় তারা কিনছিলেন, এসপ্তাহে এসে ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকায় তারা কিনছেন। ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে দামটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে বিক্রিও কম হচ্ছে বলে জানান মি. রাজবংশী।চাঁদপুরে যেখানে ইলিশের একরকম ঘাঁটি বলা যায়, সেখানেও এক কেজির মাছ ২৫০০ টাকার আশেপাশে, দেড় কেজির মাছ প্রতি কেজিতে তিন হাজার টাকার উপরে বলছিলেন চাঁদপুর বনিক সমিতির প্রেসিডেন্ট আবদুল বারী জমাদার।
কেন দাম বেশি?
এবছর দাম বেশি হওয়ার পেছনে মোটাদাগে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে ইলিশ মাছের সরবরাহ কম হওয়া। অর্থাৎ ভরা মৌসুমে প্রত্যাশার তুলনায় কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেও এখন ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না, আবার সেদেশে স্থানীয় যেসব ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তার দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম।এবছর আবহাওয়া বেশিরভাগ সময়জুড়েই অনুকূলে না থাকায় ‘জেলেরা ইলিশ ধরতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন’ বলছেন মো. আনিছুর রহমান, যিনি একজন ইলিশ গবেষক এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
একের পর এক বিভিন্ন সতর্কতা সংকেত চলছে তাতে একদিকে যেমন জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে ধরতে গেলেও সহজে সেভাবে মাছ ধরা যাচ্ছে না। “এর মানে তো এই না ইলিশ নাই, কিন্তু ইলিশ আহরণে বাধা হচ্ছে,” বলছেন মি. রহমান।অবশ্য বড় পরিসরে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে যেসব কারণে ইলিশের স্বাভাবিক বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এর মাঝে একটি নদীতে অনেক জায়গাতেই নাব্যতা কমে যাওয়া। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলে সাগর থেকে নদীতে যে পথ ধরে ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ আসে, সেখানে অনেক জায়গাতেই পলি পড়ে ডুবোচর তৈরি হয়েছে। যেখানে ইলিশ অনেকটাই গভীর পানিতে চলাচল করে সেখানে নাব্যতার সমস্যা ইলিশের স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করে।এই নাব্যতার সমস্যা শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, দেশজুড়েই নদনদীতে প্রভাব ফেলেছে। ফলে ইলিশের বিচরণের পাশাপাশি নৌযান চলাচলেও ব্যাঘাতের কারণ হয়। এছাড়াও রয়েছে দূষণের মতো সমস্যা, যার কারণে মাছের খাবার ও বিস্তারের জন্য পরিবেশ অনেক দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ সমস্যাগুলো অবশ্য নতুন নয়, চাঁদপুর বনিক সমিতির প্রেসিডেন্ট আবদুল বারী জমাদার ২০০৫ সালে ইলিশ ব্যবসায় আসেন, সেসময় থেকেই ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ঠিক করতে নদীতে ড্রেজিং হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা শুনে আসছেন।
এছাড়াও নদী ও সমুদ্রে যখন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলে তখনও অনেক দিক দিয়ে মাছ ধরা হয়। জাটকা বা মা মাছ নিধনের পাশাপাশি আছে কারেন্ট জাল ব্যবহারের মতো সমস্যাও।এছাড়া, মাছের বাজারের উচ্চ দামের জন্য অনেকে সিন্ডিকেটের অভিযোগও তুলে থাকেন। মাছ ব্যবসায়ীরা তা অস্বীকার করেন।
তবে ২০২২ সাল হতে ২০২৩ সালের দিক থেকেই নদী ও সমুদ্র দুই দিকেই ইলিশ কম পাওয়া যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছেন বলে জানান মি. জমাদার। মৎস্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে পাঁচ লক্ষ ৭১ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হয়েছিল, সেটা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে পাঁচ লক্ষ ২৯ হাজার মেট্রিক টন হয়েছিল।
অথচ এর চাহিদা কমেনি, বরং বাজারের পাশাপাশি এখন অনলাইনেও ইলিশ বিক্রি হয়, ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়া দাম বাড়ার একটা কারণ।একদিকে এমন নানাবিধ সমস্যা একই সাথে সামগ্রিক জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ আহরণ করতে যাওয়াটাও আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হচ্ছে। বড় ট্রলারগুলোতে করে মাছ ধরতে “আমি যখন ব্যবসায় এসেছি (২০০৫ সাল নাগাদ) তখন লাগতো ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা, এখন লাগে চার লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা,” এভাবেও সবকিছুর পাশাপাশি ইলিশের দামে প্রভাব পড়ে।দাম বেশি হওয়ায় বিক্রিও কম বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা ।
দাম কি এবছর কমবেই না?
নানা সমস্যা থাকলেও ইলিশের দাম কমার এখনও সুযোগ আছে।এখন ইলিশের মৌসুম শুরু হলেও সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস মূল মৌসুম বলে উল্লেখ করেন গবেষক মো. আনিছুর রহমান। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে পূর্ণিমার সময় একটা সুযোগ রয়েছে যখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বেশি মাছ ধরা সম্ভব হতে পারে বলছেন তিনি। “ধরার পরিবেশ হলেই তখন দেখা যাবে একেকটা জালে আগে যে পরিমাণ মাছ হতো তার দ্বিগুন-তিনগুন পরিমাণে মাছ পাচ্ছে” বলছেন মি. রহমান।”যদি সরবরাহ বাড়ে দুই দিন থেকে সর্বোচ্চ তিন দিন লাগে দাম কমতে, এবং সেটা দেখা যায় কেজিপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত কমে যায়” বলছিলেন মি. জমাদার।
সেপ্টেম্বর মাসে ইলিশ আরও পাওয়া যাওয়ার আশাবাদ জানাচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামানও।
“সেক্ষেত্রে দাম আমরা আশা করছি যদি ভালো ক্যাচ হয় তাহলে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত (এক কেজির) আমরা হয়তো ঘাটে পেতে পারি। এপর্যন্ত আমরা সর্বনিম্ন ২১০০ টাকা পর্যন্ত পেয়েছি (বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনায় ঘাটে এক কেজির মাছ), আরেকটু ভালো যদি ধরা যায়, তাহলে দামটা হয়তো আরেকটু কমবে” বলে ধারণা দিচ্ছেন মি. ময়েদুজ্জামান।
সমস্যাগুলোর সমাধান কি হবে?
যেসব সমস্যার কারণে সার্বিকভাবে মাছের বিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলোর সমাধান করা অতটা সহজ নয়। যেমন জলবায়ু সংকটে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা দূষণের মতো দিকগুলো ঠিক করতে যতটা সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, সেই জায়গার ঘাটতি রয়েছে।
যে সময়টাতে মাছ ধরা বন্ধ থাকার কথা, সেসময় নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও অনেক সময়েই একটু দুর্গম অঞ্চলে সব দিক দিয়ে নজরদারি সম্ভব হয়ে ওঠে না সেটা স্বীকার করেন মি. ময়েদুজ্জামান।
নাব্যতার ব্যপারে তিনি বলছেন, যেসব জায়গায় নাব্যতার সমস্যা দেখা গেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে ম্যাপিং করা হয়েছে। পরবর্তীতে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ড্রেজিং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের এই সহকারী পরিচালক।
তাদের দিক থেকে যে ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী যদি কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে ‘তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ইলিশের হ্যাবিটেট ফিরে আসা’ সম্ভব হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।তবে বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা থাকলেও তা সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে প্রশ্নের জায়গা থাকে। এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে যদি প্রতিকূলতা বাড়তেই থাকে তাহলে এর দামও নাগালের বাইরে যেতেই থাকবে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।