গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকের কুকীর্তি ফাঁস : কোটি কোটি টাকা লুটপাট


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : বাংলাদেশের ক্ষমতার অন্দরমহলে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় এক ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের নাম এখন প্রকাশ্যে এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক টিএম জুবায়ের ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষনাবেক্ষন বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (এক্সেন) আতিক। দুদকের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে এই সিন্ডিকেটের নেপথ্যের গল্প যেন নাটক কিংবা ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানায়।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি : শরুটা করা যাক সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের এক টেলিফোনালাপ দিয়ে। তিনি তার কোর্সমেট কর্নেল শহিদকে সরাসরি বলেন, “হাসিনার সব খুনখারাবি করে জিয়া আর জুবায়ের। যত কুকীর্তি আছে, জিয়া আর জুবায়েরকে দিয়ে (তারেক সিদ্দিকী) করায়, দোস্তো এখনো করায়!” আজিজ আরও উল্লেখ করেন, শেখ রেহানার দেবর জেনারেল তারিক সিদ্দিকীর নির্দেশেই এসব কর্মকাণ্ড হতো। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জুবায়ের হয়ে ওঠেন ক্ষমতাশালী গডফাদার, আর গণপূর্তের আতিক ছিলো তার মূল হাতিয়ার।
কাইয়ুমকে ভুয়া ঠিকাদার বানানো : দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, জুবায়ের তার ভায়রা ভাই খন্দকার আবুল কাইয়ুমকে ফ্রন্টম্যান বানান। আর এই পরিকল্পনার নেপথ্য কারিগর ছিলেন আতিক। তিনি বানিয়ে দেন SB Construction&Engineering (SBCE) নামের একটি লাইসেন্স। লাইসেন্স শুরু হয় মাত্র ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর ছয় মাস পরই কাইয়ুমের হাতে আসে কোটি কোটি টাকার সরকারি টেন্ডার। ভুয়া অভিজ্ঞতার কাগজ বানানো হয় ২০১৭/১৮/১৯ সালের নামে। 462838, 462840, 507769, 510586, 560483, 624287, 773005, 515763, 637782—এমন ১০টি টেন্ডার একে একে চলে যায় SBCE-এর হাতে। ফলাফল—মাত্র কয়েক মাসের কোম্পানিকে পাইয়ে দেয়া হয় ৩৭.৭০ কোটি টাকার কাজ। আর এই কাজ বাস্তবায়ন করছিলেন জুবায়েরের শ্যালক মোঃ ইশতিয়াক।
পাহাড়সম দুর্নীতি :
এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাব (০২-০৯-২০২৪) লিখেছে :“এনএসআইকে ব্যবহার করে কাইয়ুমও গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। অর্থের বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে জুবায়ের হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ।” দৈনিক সমকাল (০২-০৯-২০২৪) প্রকাশ করেছে, “এনএসআই প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা কমিশন নেন জুবায়ের। গুলশান-২ এর লেকপাড়ের বাড়ি কৌশলে আত্মীয়ের নামে দখল করেন।” দৈনিক কালবেলা (০৪-০৯-২০২৪) রিপোর্টে জানা গেছে, “কাইয়ুমের মাধ্যমে সরকার বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। এনএসআই অফিসের আসবাবপত্র কেনা ও মেরামত কাজ থেকেও কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট।”
কমিশনের নগদ লেনদেন : এনএসআই প্রধান কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্পেই বড়সড় কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। আতিক ও এক্সেন আনোয়ার নিম্নমানের ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী সরবরাহ করলে ক্ষুব্ধ হন জুবায়ের।
শেষ পর্যন্ত শেখ রেহানার মধ্যস্থতায় সমাধান হয়— দি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স লি. থেকে নগদ ১০ কোটি টাকা দেয়া হয় জুবায়েরকে চুপ করানোর জন্য। এ ছাড়া ২০১৯–২০ থেকে ২০২২–২৩ পর্যন্ত বাজেট থেকে আরও ৪০ কোটির বেশি টাকা “মেরামতের নামে” এনএসআই ভবনে ঢোকানো হয়।
গুলশানের রাষ্ট্রীয় বাড়ি দখল : দুদকের অভিযোগে উঠে এসেছে, রাজধানীর গুলশান-২ এর লেকপাড়ের ৮৪ নম্বর বাড়ি দখল করেন জুবায়ের। এই বাড়ি ছিল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ব্যবহৃত হতো এনএসআই অফিস হিসেবে। আতিকের সহায়তায় বাড়িটি আত্মীয়ের নামে লিখে নেয় সিন্ডিকেট। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, গুলশানের ১২৮টি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে ৬০টির মূল নথি নেই—এই শূন্যতাকেই কাজে লাগানো হয়।
আতিক–জুবায়ের–তারিক: এক ত্রিমুখী আঁতাত : এই সিন্ডিকেট ছিল ত্রিমুখী। তারিক সিদ্দিকী রাজনৈতিক শক্তি ও ছত্রছায়া দিয়েছেন। টিএম জুবায়ের ছিলেন পরিকল্পনাকারী ও সুবিধাভোগী। আর আতিক ছিলেন মাঠ পর্যায়ের “কিংপিন”, যিনি ভুয়া টেন্ডার, কাগজপত্র ও কারসাজি সামলাতেন।
গাজীপুর এনএসআই ভবন, গাজীপুর ডায়বেটিস হাসপাতাল, পরিকল্পনা কমিশন এর শহীদ মিনার, নার্সেস ডরমেটরির ভার্টিক্যাল এক্সটেনশন, এমনকি এনএসআই সদর দপ্তর নির্মাণ প্রকল্প এর বিভিন্ন কাজ—সব জায়গায় তাদের কমিশনের খেলা চলেছে।
শেষকথা : দুদকের অনুসন্ধান একে একে প্রমাণ করছে— ভুয়া লাইসেন্স, জাল টেন্ডার, ভায়রা ভাইকে ফ্রন্টম্যান বানানো, কমিশনের নগদ লেনদেন, রাষ্ট্রীয় বাড়ি দখল- সবকিছুর মূল চরিত্র ছিলেন আতিক।
এখন সচেতন মহলের প্রশ্ন?
এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কি সিন্ডিকেটকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে, নাকি রাজনৈতিক আশ্রয়ে তারা আবারও অদৃশ্য শক্তি হয়ে উঠবে?
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।