গণপূর্তে ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেটের দাপট : চট্টগ্রাম করভবন প্রকল্পকে ঘিরে দুর্নীতির নায়ক মেহেদীর পদায়ন


ইত্তেহাদ নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান হলেও ফ্যাসিবাদের দোসররা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোয় নতুন মুখে, পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে আলোচনায় এসেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার যিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে টানা তিন বছর একই পদে ছিলেন এখনও তার পুরনো সিন্ডিকেট আঁকড়ে আছেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাকে সরাবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তার উপর আস্থা রাখলেও পরিবর্তে আবারও তিনি আলোচিত- সমালোচিত পদায়নের ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম কর ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ছবি।
করভবন প্রকল্পকে ঘিরে মেহেদীর পদায়ন : ফ্যাসিবাদের দোসর এই মেহেদীকেই এবার চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদায়িত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে এই নিয়োগের মূল লক্ষ্যই হলো UCC Infrastructure Ltd-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিজওয়ান মোস্তাফিজ এর ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের চট্টগ্রাম করভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজটি তার কোম্পানির আওতায় আনা। শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ- ৩ এর এক্সেন আতিকুল ইসলাম আতিক যিনি দীর্ঘদিন ধরে গণপূর্তের টেন্ডার সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
মেহেদীর পারিবারিক শক্তিঃ গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মোঃ মহাসীন মোল্ল্যা, যাকে স্থানীয়ভাবে সবাই কায়েস চেয়ারম্যান হিসেবেই চেনে, তার ছেলে মেহেদী হাসান।
মহাসীন মোল্ল্যা ওরফে কায়েস চেয়ারম্যান শুধু জনপ্রতিনিধিই ছিলেন না, ছিলেন গোপালগঞ্জ আওয়ামীলীগের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে মেহেদী হাসান ছিলেন চুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, তাকেই আজ গণপূর্তের টেন্ডারবাজিতে নতুনভাবে পুরনো খেলোয় নামানো হয়েছে। বাসার সামনে অর্থাৎ কাশিয়ানি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা কমপ্লেক্সের বিপরীতে রয়েছে কায়েস চেয়ারম্যান মার্কেট এবং এই মার্কেটের পেছনেই তার বাসা। এছাড়া ঢাকা খুলনা মহাসড়কের পাশে কাশিয়ানিতে কায়েজের ইটের ভাটাও রয়েছে। মেহেদীর স্ত্রী কাজী রুকাইয়া সুলতানা বিসিএস ট্যাক্স ক্যাডারের একজন সদস্য এবং সাবেক গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াসিউদ্দীন এর ছোট বোন।
সে সুবাদে মেহেদী ছিলেন সচিবের বোন জামাই, বোন, এর সুবাদে মেহেদী সচিব পরিবারের ‘ঘনিষ্ঠ বৃত্তে’ প্রবেশের সুযোগ পান ফলে, গণপূর্তে একটা সময় এই মেহেদীর প্রভাব ছিল অকল্পনীয়। এছাড়াও বিএসএমএমইউ এর সাবেক ভিসি এবং অসংখ্য দূর্ণীতির ঘটনার নায়ক অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার চাচ্য শেখ কবির ছিলো তার নিকটাত্মীয়। হাসিনার চাচা শেখ কবির (লোকমুখে প্রচলিত কবির চাচা) কে গণপূর্তের ঠিকাদারি কাজে অর্ন্তভুক্ত করা এবং তার ঠিকাদারী সকল কাজকর্ম দেখভাল করা ছিলো মেহেদীর অলিখিত দায়িত্ব।
মেহেদীর পদোন্নতি ও পলায়নের টাইমলাইন :
২০১৩ (অক্টোবর): ৩২তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গণপূর্ত কাঠের কারখানা বিভাগে যোগদান। ২০১৪ (২৩ নভেম্বর): শরীয়তপুর থেকে বরিশাল উপ-বিভাগ- ১ এ পদায়ন। ২০১৬ (২৪ আগস্ট): শেরে বাংলা নগর উপ-বিভাগ- ৪ এ যোগদান। ২০১৭ (৬ ডিসেম্বর): মিরপুর উপ-বিভাগ-৩ এ দীর্ঘ ছয় বছরের দায়িত্ব পালন। ২০২৩ (১১ অক্টোবর): নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে শেরে বাংলা নগর বিভাগ-২ এ প্রথম পদায়ন। ২০২৪ (২১ আগস্ট): হাসিনা সরকারের পতনের পর গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিটে কৌশলগত পদায়ন। ২০২৫ (৪ সেপ্টেম্বর): হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-৪ এ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
সিন্ডিকেটের অন্দরকথা : সূত্র বলছে, আতিকের টেন্ডার সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী করার জন্যই মেহেদীর চট্টগ্রাম পদায়ন। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সাবেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও নাম। একসময় এনডিই গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা রায়হান মোস্তাফিজ ও রেজওয়ান মোস্তাফিজ এখনো আড়ালে গণপূর্তে প্রভাব খাটাচ্ছেন। রেজওয়ান বর্তমানে ভোল পালটে UCC Infrastructure Li d- এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে টেন্ডার সিন্ডিকেটের বড় খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত।উপদেষ্টাকে আতিক সিন্ডিকেট বোঝাচ্ছে রায়হান মোস্তাফিজ ফ্যাসিস্ট হলেও রেজওয়ান মোস্তাফিজ আলাদা সত্ত্বা।
কিন্তু ভেতরের খবর তো ভিন্ন। এনডিই কোম্পানি থেকে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে রায়হান প্রথমে মেঝোভাই রেজওয়ানকে আলাদা ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছে এবং এনডিই এর লাইসেন্স দিয়ে জেভি করিয়ে কাজ দিয়েছে নতুন কোম্পানিতে। এরপর মাহাবুব গ্রুপকে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে চতুর রায়হান মোস্তাফিজ ৪০০ কোটি টাকা ক্যাশ নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। দুইভাই কানাডায় বসে ৮০০ কোটি টাকা দিয়ে এখন নতুন কোম্পানি UCC Infrastructure LI d দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। গণপূর্তের আগের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখার সকল ব্যবস্থা করে দিচ্ছে আতিক।
প্রশ্ন উঠছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম কি সত্যিই স্বচ্ছতা আনছে, নাকি পুরনো ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেটকেই নতুন করে জায়গা করে দিচ্ছে?প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার যেভাবে আতিক সিন্ডিকেটের লুটপাট আগলে রেখেছেন, তাতে অনেকেই মনে করছেন তিনি এখনো আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ঘরানার ‘সহচর’ হয়েই আং বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খানের চোখের সামনেই যখন এই পদায়ন হচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে, সংস্কারের নামে কি আবারও ফ্যাসিবাদের পুরনো খেলা ফিরে আসছে?”
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।