বাংলাদেশ বরিশাল

ভোলা উপকূলে জেলেদের জালের জীবন জলে বন্দী

print news

ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন গাঙ্গেয় দ্বীপের জেলা ভোলা। ৩ হাজার ৪০৩.৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় প্রায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস। সাতটি উপজেলা আর তিনটি প্রশাসনিক থানা নিয়ে গঠিত জেলাটিতে সরকারি তালিকাভুক্ত জেলেদের সংখ্যা এক লাখ ৭১ হাজার এবং সমুদ্রে মাছ শিকার করেন এমন জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৯৫৪ জন। আর বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী, এ সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখের বেশি। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে দিনাতিপাত কাটে এখানকার সংগ্রামী মানুষজনের। উপকূলীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশের পেশাই হচ্ছে-মৎস্য আহরণ। মেঘনা, তেতুলিয়া, কালাবাদর, ইলিশা আর বেতুয়া নদীর জাল, জ্বলা আর মাছের সাথে মিতালী করেই এখানকার জেলেদের জীবন জীবিকার প্রহর কাটে। ভোলা উপকূলের নদ-নদীতে মাছ পাওয়া না পাওয়ার ওপর নির্ভর করে এখানকার জেলেদের রুটি রুজির নিশ্চয়তা। সাগর আর নদীতে মাছের গতি প্রকৃতির সাথে জেলেদের ভাগ্য সবদলের চাকা ঘোরে।

ভোলার জেলেদের জীবনের সাতকাহন জানতে এখানকার জেলে পল্লীগুলোতে সরেজমিন বিচরণ করা হয়। সেখানে গিয়ে শোনা যায় তাদের অব্যক্ত অভাব আর নিরব কান্নার নোনাপানির এক নিদারুণ আর্তনাদের কথা।

ভোলা সদরের তুলাতুলি ভেড়ি পাড়ের জেলেপাড়ায় গিয়ে কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ জেলে সফিউল মাঝির সাথে। তিনি জানান, প্রমত্ত্বা মেঘনার অদূরের মাঝের চরে তাদের বসত ছিলো। মেঘনার ভাঙ্গনে তাদের ভিটেমাটি নদীর পেটে গেছে বহ আগেই। বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের নেশা ও পেশাই ছিলো নদীতে মাছ ধরা। একসময় তারা নিজেরাই সুতা কিনে জাল বুনতো। মান্ধাতা পদ্ধতিতে বোনা এ জালগুলোর অধিকাংশই তৈরি হতো ইলিশ শিকারের জন্য। অন্য প্রজাতির মাছ ধরতে বোনা হতো ভিন্ন কায়দায় জাল। তিনি বলেন, বাপ-দাদায় জাল লয়া দইজ্জায় (নদীতে) যাইতো। জলের দমায় (প্রবল স্রোতে) আল্লার আতে জীবন সূইপ্পা দিতো। মাছের চাইন পড়লে খায়া পইর‌্যা ভালাই থাকতাম। তিনি জানান, পূর্বপুরুষের জাল বোনা আর মাছ ধরার সেই পেশাকে সম্মান করে আমি ও আমার সন্তানরাও জালের জীবন জ্বলে বন্দী করে সময় পাড় করছি। মাছ পাইলে ভাত মিলে, না পাইলে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি।

একই পল্লীর বাসিন্দা জয়নব বিবির সাথে কথা হলে তিনি জানান, মেঘনা মধ্যবর্তী রামদেবপুর চরে ছিলো তাদের বাড়ি। একই এলাকার অধিবাসী সালাউদ্দিন মাঝির ছেলে মাইনউদ্দিন মাঝির সাথে চল্লিশ বছর আগে বিয়ে হয় তার। জয়নব বিবির বাবা সিহাব মাঝির ছিলো মাছধরার কয়েকটি ছান্দি নৌকা, মাছের আড়ৎ আর জাল বেচার ব্যবসা। অর্থ সম্পদের শক্তির কারণেই মাইনউদ্দিন মাঝির পরিবারের সাথে জয়নব পরিবারের আত্তা। বিয়ের পর মাছধরার আয়ে তাদের জীবন সুখেই কাটছিলো। চার সন্তানের জননী জয়নবের সেই সুখের জীবন দূ:খের নদীর লোনা জলে মিশে যায়। নিজেদের বোনা জাল আর নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে মেঘনায় গিয়ে চার বছর আগে নদীর প্রবল স্রোতে হারিয়ে যায় স্বামী মাইনউদ্দিন মাঝি। তার লাশটিও কেউ খুঁজে পায়নি। ছেলেমেয়েরা বাবার জাল, নৌকা আর ইঞ্জিন ভাগাভাগি করে নিয়ে তারা এখন অন্য গ্রামে ভিন্ন সংসার পেতেছে। এখন জয়নবের খবর নেয়না কেউ। জীবন সায়াহ্নে এসে জয়নব তার স্বামীর স্মৃতি বুকে নিয়ে এখন চেয়ে থাকেন মেঘনায় ভেসে বেড়ানো মাছধরা নৌকা, জাল, জ্বলা আর জেলেদের দিকে। একা মানুষ। একটি পেট। তবুও ভাত-কাপড়ের অভাব তাড়িয়ে বেড়ায় জয়নব বিবিকে। স্বামীর বোনা জালে, যে জ্বলে নৌকা ভাসিয়ে মাছধরা আয়ে সুখের জীবন কাটতো জয়নবের সেই জ্বলের স্রোতেই ভেসে গেছে স্বামী মাইনউদ্দিন মাঝি।

সফিউল মাঝি আর জয়নব বিবিদের মতো উপকূলের অসংখ্য জেলেদের জালের জীবনের হাজারো গল্প-উপাখ্যাণ মিশে আছে প্রমত্ত্বা মেঘনার ঘোলা পানির স্রোতে।উপকূলীয় জেলা ভোলা ও তৎসংলগ্ন জেলাগুলোর সাগর ও নদনদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত ট্রলার ও নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হচ্ছেন অসংখ্য জেলে।এদের মধ্যে কিছু কিছু জেলের লাশ পাওয়া গেলেও অধিকাংশই থাকেন নিখোঁজ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে স্বজনদের কষ্ট কান্নার যেনো শেষ নেই।

সংশ্লিষ্ট একাধিক তথ্যসূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে গত ১০ বছরে ভোলার চরফ্যাশনেরই দুই শতাধিক জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত দুর্যোগ মৌসুম। আর এই দুর্যোগ মৌসুম মানেই উপকূলবাসীর জন্য বন্যা কিংবা জলচ্ছ্বাসের আতঙ্কের সময়। সেই সাথে জেলে পরিবারগুলোতে থাকে স্বজন হারানোর ভয়। সূত্র আরও জানায়, চরফ্যাশন উপজেলায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছে। সেখানে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮১ জন। অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে আরো ৪৬ হাজার। এসব জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে। এ অঞ্চলে ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে। এসব জেলেদের মধ্যে ২০১৫ সালে ১১ জন, ২০১৬ সালে ১৯ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৯ সালে ৪৮ জন, ২০২০ সালে ৯ জন, ২০২১ সালে ৯ জন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ জন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৫ জন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ জন জেলে নদী ও সাগরে নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন।

২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো সব জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক প্রদান করা হয়েছে। তবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ ৬৬ জেলের মধ্যে ২২ জেলে পরিবার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৮ জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক প্রদান করা হয়েছে।

অন্যান্য সময় জেলে পরিবার আর্থিক অনুদানের চেক পেলেও ২০১৮ সালে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো জেলে পরিবারের ভাগ্যে কোনো অনুদান জুটেনি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিগত বছরের তুলনায় চরফ্যাশন উপজেলায় ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২২ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ১২৪ জন জেলে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে। এদের অনেকের লাশ পাওয়া গেলেও অন্যদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ জেলেরা হলেন, চর মাদ্রাজ, আসলামপুর, মাদ্রাজ, জিন্নাগড়, আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, আহম্মদপুর, ওসমানগঞ্জ, এওয়াজপুর, হাজারীগঞ্জ, জাহানপুর, রসুলপুর, চর মনিকা, চর কুকরি মুকরি, চর পাতিলা, নজরুল নগর, মুজিব নগর, ঢালচর, নুরাবাদ, নীলকমল, আব্দুল্লাহপুর, চরকলমী এলাকার।

সংশ্লিষ্ট তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে প্রণীত জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিতে বলা হয়, ‘জাল যার জ্বলা তার’। এছাড়াও বলা হয়, যিনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার এবং বিক্রয় করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি প্রকৃত মৎস্যজীবী বলে গণ্য হবেন এবং নির্দিষ্ট জল মহালের নিকটবর্তী ও তীরবর্তী প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সমিতি যা সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত যে সমিতি বা সমিতি সমূহ নির্দিষ্ট ও তীরবর্তী জলমহাল ব্যবস্থাপনার জন্য আবেদন করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি বা অনিবন্ধিত সংগঠন আবেদন করতে পারবে না।

আর এখানেই বেশির ভাগ জেলে নিয়মের ফাঁকিতে সংগঠনের সদস্য হতে পারছেন না। কিংবা তাদের অনেকেই জানে না কিভাবে মৎস্য সমবায় সমিতি গঠন করতে হয়। ফলে জলমহাল ব্যবস্থাপনায় জেলেদের কপালে লেখা হচ্ছে- ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় জেলা ভোলার অধিকাংশ জেলেকেই রাখা হয়েছে অধিকারের অন্ধকারে। মৎস্যজীবি সমিতির নেতারা অভিযোগ করে জানান, বিগত স্বৈরজমানায় উপকূলীয় জেলাগুলোর জলমহালের সকল সরকারি বরাদ্ধ সরকার দলের রাঘববোয়ালদের পেটে চলে যেতো। জুলাই বিপ্লবের পরও উপকূলের বিভিন্ন জেলায় সরকারি জলমহাল থাকলেও সেগুলো এখনো কিছু দুর্বৃত্তচক্রের কব্জায়। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন থেকে নানা কৌশলে লীজ নিয়ে সেখানে মাছ চাষ করলেও জেলেরা সেগুলোর ধারে কাছেও যেতে পারেন না।

ভোলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ভূঁইয়া  বলেন, অতীতে ভোলার জেলেদের সঠিক তালিকা নিয়ে নানা অভিযোগ ছিলো। আগামীতে মৎস্য উদ্যোক্তা ও জেলেদের পুনর্বাসনে বর্তমান সরকার কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.