নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় পাকিস্তান কি সৌদি আরবকে পারমাণবিক সুরক্ষা দেবে?


বিবিসি: পাকিস্তান ও সৌদি আরব নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি ‘যৌথ কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি’-তে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ‘কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে’।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের নেতারা এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এই প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব সংক্রান্ত চুক্তিটি এমন এক সময়ে ঘোষণা করা হলো, যখন সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে আরব দেশগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে।
রিয়াদের আল ইয়ামামা প্রাসাদে মোহাম্মদ বিন সালমান ও শাহবাজ শরিফের বৈঠকের পর জারি করা এক যৌথ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে গত আট দশক ধরে বিদ্যমান কৌশলগত স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের প্রেক্ষাপটে এই ‘যৌথ কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। কোনো এক দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।’
এতে আরও বলা হয়, এই চুক্তিটি নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার পাশাপাশি এই অঞ্চলসহ বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ও সৌদি আরবের যৌথ অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
চুক্তির পর সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক বার্তায় বলেন, “সৌদি আরব ও পাকিস্তান… আগ্রাসীর বিরুদ্ধে এক সারিতে… চিরকাল এবং অনন্তকাল।”
উল্লেখ্য, দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার ইতিহাস কয়েক দশক পুরনো। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটে পাকিস্তানের সহযোগিতায় যে বিশেষ বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল, তার নেতৃত্ব পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) রাহিল শরিফকে দেওয়া হয়েছিল।
যদিও দুই দেশের পক্ষ থেকে এই চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি, তবে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়া এসেছে।
সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি প্রসঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির দিকে নজর রাখছি এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার উপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো খতিয়ে দেখছি। ভারত সরকার তার স্বার্থ রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
পাকিস্তান ও ভারতের সাংবাদিকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরাও এই চুক্তি নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করছেন।
পাকিস্তানের সাংবাদিক তালাত হুসাইন প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের একটি ভিডিও শেয়ার করে লিখেছেন, “এটি বিপুল সম্পদ এবং শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতার একীভূত হওয়ার মতো, এটি একটি গেম চেঞ্জিং সমন্বয়। এর চেয়ে সময়োপযোগী এবং কৌশলগত আর কিছু হতে পারত না।”
দেশটির সাবেক মন্ত্রী মুাহিদ হুসাইন সৈয়দ এক্সে লিখেছেন, “এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে নীরবে পশ্চিমা বিশ্বকে প্রতিস্থাপন করেছে।”
এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি আরও বলেন, “দুটি মুসলিম দেশের মধ্যে এই ঐতিহাসিক ও সময়োপযোগী কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি তিনটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রথমত, এটি কাতারের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং আরবদের সাথে আমেরিকার বিশ্বাসঘাতকতার পর স্বাক্ষরিত হলো। দ্বিতীয়ত, এটি এমন সময়ে হয়েছে যখন ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিন, কাতার, ইরান, লেবানন ও ইয়েমেনে হামলা চালানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, এই চুক্তিটি এমন সময় হলো যখন ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দক্ষতা ও সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতকে জবাব দিয়েছে।”
ভারতীয় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার এক্সে যৌথ ঘোষণার একটি অংশ শেয়ার করে লিখেছেন, “কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়ায় সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে এই পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের আগে থেকে চলমান ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর জন্য এর অর্থ কী দাঁড়াবে?”
ভারতীয় নাগরিক তেজস্বী প্রকাশ এই চুক্তিকে ‘বিস্ময়কর’ বলে অভিহিত করেছেন। এক্সে তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তান সৌদি আরবের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, যার অধীনে এক দেশের উপর হামলা অন্য দেশের উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে। এটি একটি গুরুতর কৌশলগত পরিবর্তন, যা ইসলামাবাদের নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করবে।” তেজস্বী প্রকাশ তার এক্স প্রোফাইলে নিজেকে কংগ্রেস পার্টির সদস্য বলে পরিচয় দেন। তিনি মোদী সরকারের সমালোচনা করে লিখেছেন, “মোদী সরকার ছবি ও প্রোপাগান্ডা দিয়ে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখছে, অথচ মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের প্রভাব কমে যাচ্ছে।”
পারমাণবিক অস্ত্র গবেষক ও লেখক রাবিয়া আখতারের মতে, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, কিন্তু বর্তমান চুক্তিটি সেই নিরাপত্তা সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার বিষয়ে আমি মনে করি, এটি একটি স্পষ্ট আশ্বাস, কিন্তু এটি কোনো আদর্শিক পরিবর্তন নয়। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়াদকে পারমাণবিক সুরক্ষা দেবে, এমন সম্ভাবনা কম। কিন্তু এ বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকাই সৌদি আরবের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আফগানিস্তানের জন্য নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ লিখেছেন, “পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির ঘোষণা একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। (এটি কোনো ‘ট্রিটি’ বা সন্ধি নয়, তবে পাকিস্তান ও সৌদি আরব ‘ট্রিটি’ এবং ‘এগ্রিমেন্ট’-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করে কি না তা জানা যায়নি)।”
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “এক দেশের উপর হামলাকে অন্য দেশের উপর হামলা বলে গণ্য করা হবে। এটা কি কাতারে ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়া? নাকি এটি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে প্রচলিত সেই গুজবের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি যে, এর পেছনে সৌদি অর্থায়ন রয়েছে?”
তিনি আরও প্রশ্ন করেন, “এই চুক্তিতে কি কোনো গোপন শর্ত আছে? থাকলে সেগুলো কী? এই চুক্তি কি প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর সৌদি আরব এবং সম্ভবত অন্যদের আস্থা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়? পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ও ডেলিভারি সিস্টেম রয়েছে, যা ইসরায়েলসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তারা এমন সিস্টেমও তৈরি করছে যা আমেরিকায় পৌঁছাতে পারে। প্রশ্ন অনেক…”
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।