ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নিয়োগ হলো বিসিএস পরীক্ষা। কঠোর প্রতিযোগিতা, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ও বহু বছরের পরিশ্রম শেষে একজন প্রার্থী বিসিএস ক্যাডারে প্রবেশ করেন। কিন্তু সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকাশিত এক কেলেঙ্কারি এই কাঠামোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে। অভিযোগ উঠেছে, বিসিএস পাশ না করেই কয়েকজন প্রকৌশলী সরাসরি ষষ্ঠ গ্রেডে চাকরি পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, আদালতের রায় উপেক্ষা করে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং ‘ব্যাকডেট’ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার বেতনও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার ফলে একদিকে যেমন বৈধ কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা লুট হয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুসন্ধানী দৃষ্টিকোণ থেকে কেলেঙ্কারির মূল চরিত্র, ঘটনাক্রম, আর্থিক ক্ষতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণ করবে।
২০১২ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরে এক ব্যতিক্রমী নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হয়। সমীরণ মিস্ত্রি, জাহাঙ্গীর আলম, জিয়াউর রহমান, মো. আবু তালেব, নাফিজসহ কয়েকজন প্রকৌশলী বিসিএস পরীক্ষা এড়িয়ে কেবলমাত্র ভাইভা দিয়ে চাকরি পান। যেখানে সাধারণ প্রকৌশলীরা নবম গ্রেড থেকে শুরু করেন, সেখানে এরা সরাসরি ষষ্ঠ গ্রেডে প্রবেশ করেন।
তাদের নিয়োগের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, শেখ পরিবারের নিকটজনদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এই কয়েকজনের ভাগ্য রাতারাতি বদলে যায়। সাধারণ প্রার্থীরা যেখানে বছরে হাজার হাজার প্রার্থী নিয়ে প্রতিযোগিতা করে, সেখানে এরা কোনো লিখিত পরীক্ষাই না দিয়েই উচ্চ পদে প্রবেশ করেন।
এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে গণপূর্তের বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তারা আদালতে রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট সেই রিটের প্রেক্ষিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দেন, অর্থাৎ তাদের পদোন্নতি বা স্থায়ী নিয়োগ না দেওয়ার নির্দেশ ছিল।
কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রশাসন সেই নির্দেশ মানেনি। বরং অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে বৈধ বিসিএস কর্মকর্তারা একের পর এক পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন।
একজন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা বলেন “আমরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এসেছি। অথচ যারা কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ঢুকেছে, তারাই এখন আমাদের সিনিয়র হয়ে গেছে। এটা শুধু অন্যায় নয়, প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের প্রতি একধরনের কটাক্ষ।”
এই কেলেঙ্কারির সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো ‘ব্যাকডেট চাকরি’। বিশেষ করে প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলমের নাম এখানে উঠে আসে।
তথ্য অনুযায়ী, তিনি ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)-তে কর্মরত ছিলেন। অথচ গণপূর্ত অধিদপ্তরে দেখানো হয় তিনি ওই সময় থেকেই চাকরি করছেন। অর্থাৎ, তাকে ব্যাকডেট দিয়ে নিয়োগ দেখানো হয়।
ফলে আদালতের স্থগিতাদেশ চলাকালীন সময়েই তাকে গণপূর্তে যোগদানকারী হিসেবে দেখানো হয়। এই ঘটনা শুধু আদালত অবমাননাই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের এক বিরল উদাহরণ।
জাহাঙ্গীর আলমের ঘটনা প্রশাসনিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কারণ তিনি একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠানের বেতন তুলেছেন।
২০১২-২০১৬ : নিয়মিতভাবে বিআইডাব্লিউটিএ থেকে বেতন নিয়েছেন।
একই সময়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে ব্যাকডেট দেখিয়ে চার বছরের এককালীন বকেয়া বেতন নিয়েছেন।
অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পূর্ণ বেতন নিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপর এমন ডাবল লুটপাট বাংলাদেশ প্রশাসনিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
জাহাঙ্গীর আলম একা নন। আরও কয়েকজন প্রকৌশলী একইভাবে ব্যাকডেট সুবিধা নিয়ে কোটি কোটি টাকা তুলে নেন।
অভিযোগ রয়েছে, কেউ কেউ ছয় থেকে সাত বছরের বকেয়া বেতন একসাথে পেয়েছেন। এতে সরকারের রাজস্ব খাতে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন “এটি সরাসরি অর্থনৈতিক অপরাধ। রাষ্ট্রের টাকা এভাবে আত্মসাৎ করা হলে সাধারণ মানুষ কর দিয়ে কী লাভ পাচ্ছে? এদের বিরুদ্ধে যদি উদাহরণযোগ্য ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় কেলেঙ্কারি ঘটবে।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরে বৈধভাবে বিসিএস দিয়ে আসা প্রকৌশলীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকে দীর্ঘদিন পদোন্নতি পাননি শুধু অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তরা সিনিয়র হয়ে যাওয়ার কারণে।
এতে একদিকে কর্মক্ষেত্রে হতাশা বাড়ছে, অন্যদিকে যোগ্য কর্মকর্তারা বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে রাষ্ট্র হারাচ্ছে মেধাবী জনবল, আর দুর্নীতিবাজরা ভোগ করছে ক্ষমতার আসন।
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা ফের হাইকোর্টে মামলা করেছেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা।
প্রশ্ন হলো- আদালত কি সত্যিকার বিচার করবে, নাকি আবারও অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বিষয়টি চাপা পড়বে?
একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন-“এই মামলাটি শুধু কয়েকজন কর্মকর্তার অবৈধ নিয়োগের বিচার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরীক্ষা।”
অনেকের মতে, এ ধরনের নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্ভব হতো না যদি রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকত। শেখ পরিবারের নিকটজন হওয়ায় এই প্রকৌশলীরা বারবার প্রশাসনিক ও আইনি বাধা অতিক্রম করেছেন।
দলীয় আনুগত্যের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় চাকরিতে এভাবে প্রবেশের সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি এর ভয়াবহ রূপ তুলে ধরেছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত