মামুনুর রশীদ নোমানী,বরিশাল: আয়নাঘরের জনক,গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের ব্যবসায়িক পার্টনার বরিশালের কুখ্যাত ভূমিদস্যু মোঃ এমদাদুল হক সুরুজ মোল্লাকে ঢাকার পুলিশ বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার সহযোগীতায় ১৯ অক্টোবর আটক করেছে।অপর সহযোগী কামরুল এখনো ধরাছোয়ার বাইরে।
কে এই সুরুজ মোল্লা:
পুরো নাম মোঃ এমদাদুল হক সুরুজ মোল্লা।ভুমি দস্যু সুরুজ মোল্লা নামে পরিচিত। কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড ওকনফিডেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল করীমের বিরুদ্ধে বরিশালে মামলা করে আলোচনায় আসেন এই ভুমি দস্যু সুরুজ মোল্লা।জিয়াউল আহসানের থেকে টাকা নিয়ে জমি,বালুর ব্যবসা করে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। জিয়াউল আহসানের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জমি দখল,একই জমি একাধিকবার বিক্রিসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সুরুজ মোল্লা। বরিশালের মেরিন একাডেমী এলাকায় সুরুজ গংএর থেকে ১৩ শতাংশ জমি দলিলমুলে ক্রয় করলেও পরে সুরুজ মোল্লা দলিল গ্রহিতা বাকেরগঞ্জের মিজানুর রহমান মল্লিক ও বানারীপাড়ার জালিস মাহমুদের ৮ শতাংশ জমি দখল করে।টাকাও ফেরৎ পায়নি, এমনকি জমিও ফেরৎ পায়নি তারা সুরুজ মোল্লার কাছে থেকে।এ নিয়ে মিজানুর রহমান মল্লিক ও জালিস মাহমুদ সাংবাদিক সম্মেলনও করেছিল।
জমি বা টাকা ফেরৎ চাইলে সুরুজ মোল্লা তাদের বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করে। অবৈধ টাকা ও জিয়াউল আহসানের ক্ষমতার প্রভাবে সুরুজ মোল্লা বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের উপ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মোটর সসাইকেল প্রতীতে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।
সুরুজ মোল্লা আ'লীগের সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক গ্রুপের লোক ছিল।বসবাস করেন বরিশাল নগরীর রুপাতলী হাউজিং এলাকায়।
সুরুজ মোল্লার বিরুদ্ধে তার আপন ফুফুদের জমি আত্মসাৎ,কর্নকাঠি,চরকাউয়াসহ বিভিন্ন স্থানে অসহায়,নিরীহ মানুষের জমি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। রুপাতলী হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আকরাম জানান,সুরুজ মোল্লা একজন চিন্থিত ভুসিদস্যু।তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।পাশাপাশি আয়নাঘরের মাস্টারমাইন্ড জিয়াউল আহসানের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
কে এই জিয়াউল আহসান
জিয়াউল আহসান সেনবাহিনীর পাশাপাাশি র্যাব, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থা, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মজীবনের বিগত এক দশকের বেশি সময় গুম, খুন ও ব্যক্তিগত ফোনকল আড়িপাতাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনি সমালোচিত হয়েছে। তবে তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন।
জিয়াউল আহসানের জন্ম ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর, ঝলকাঠি জেলায়। ১৯৯১ সালের ২১ জুন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদাতিক কর্মকর্তা হিসেবে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও স্কাই ডাইভার।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালী জিয়াউলকে র্যাব-২-এর ভাইস-ক্যাপ্টেন করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ওই বছরের ২৭ আগস্ট র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (গোয়েন্দা শাখা) পরিচালকের দায়িত্ব পান তিনি।
তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৩ সালে জিয়াউল আহসান পদোন্নতি পেয়ে কর্নেল হয়ে যান এবং একই সময়ে তাকে র্যারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আড়াই বছর পর ২০১৬ সালের এপ্রিলে পদোন্নতি পেয়ে বিগ্রেডিয়ার হয়ে গেলে তাকে এনএসআইতে (ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স) পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে জিয়াউলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এনটিএমসির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২১ জুলাই এনটিএমসিতে মহাপরিচালক (ডিজি) পদ তৈরি করা হয় এবং জিয়াউলকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি এনটিএমসির প্রথম মহাপরিচালক হন। এই পদে থাকা অবস্থায় ৬ আগস্ট তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
উল্লেখ্য. এনটিএমসি তথ্য ও যোগাযোগের ডেটা পর্যবেক্ষণ, সংগ্রহ ও রেকর্ড করার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক যোগাযোগ যেমন ফোনকল, ই-মেইল ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ইন্টারসেপ্ট করে থাকে।
আয়নাঘরের 'জনক'
কথিত গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর তৈরি করে সেখানে বিরোধী মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর গুম করে রাখার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে।পুলিশও দাবি করেছে, কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান আয়নাঘর এবং ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যার সঙ্গে থাকার কথা স্বীকার করেছেন।ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে করা আবেদনে এমনটাই দাবি করে পুলিশ। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এসব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।যদিও আদালতে শুনানির সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জিয়াউল আহসান।
মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড করতেন জিয়াউল আহসান
এনটিএমসিতে দায়িত্ব পাওয়ার পর জিয়াউল আহসান সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় হাইপ্রোফাইল নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করতেন।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল ফাঁস করে তা বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপ রেকর্ডের সারাংশ গণভবন থেকে উদ্ধার হয়। তাতে আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা কৌশলের তথ্য উঠে আসে।এনটিএমসিতে কর্মরত ছিলেন, এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জিয়াউল আহসান অনেকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করতেন। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের কল রেকর্ড করে সেগুলো শুনতেন।'
ইন্টারনেট সেবা বন্ধেও জড়িত ছিল জিয়াউল আহসান
কোটা সংস্কারের দাবি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করা হয়। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ডাটা সেন্টারগুলো বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কয়েকটি ডাটা সেন্টারে হুমকি দিয়ে বন্ধ করেন জিয়াউল আহসান।
গুম-খুনের 'মাস্টারমাইন্ড' জিয়াউল আহসান
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হন। এই তালিকায়্ ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলামসহ একাধিক হাইপ্রোফাইল নেতাও ছিলেন। অভিযোগ আছে, বিচারবর্হিভূত এসব হত্যাকাণ্ডের মিশন বাস্তবায়ন করেছেন পুলিশের এলিটে ফোর্স র্যাব।
গুম ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন জিয়াউল আহসান। তার ইন্ধনে ঢাকা মহানগরীতে গুম ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিকাল ৩টার দিকে ইলিয়াস আলী সিলেট থেকে বিমানযোগে ঢাকা আসেন। ওইদিন রাতে হোটেল শেরাটন থেকে বাসায় ফেরার পথে তাকে গুম করা হয়।
সূত্রের দাবি, ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউল আহসান। তিনি ওইদিন ইলিয়াস আলী যে ফ্লাইটে সিলেট থেকে ঢাকা এসেছিলেন, সেই ফ্লাইটেরই যাত্রী হয়ে তাকে অনুসরণ করছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনেও ছিল 'সম্পৃক্ততা'
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় সম্পৃক্তার অভিযোগ উঠেছিল মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। সেই সময় তিনি র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন। ওই সময় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন।
সূত্রের দাবি, জিয়াউল আহসান ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন; কিন্তু তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি বেঁচে যান।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত