বাংলাদেশ বরিশাল

বরিশাল সরকারি মডেল স্কুলের শিক্ষক তৃষানের কোচিং ব্যবসা রমরমা

সরকারি মডেল স্কুল
print news

বরিশাল অফিস : বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক তৃষানের কোচিং ব্যবসা রমরমা।কোন শিক্ষার্থী কোচিংয়ে না পড়লে পরীক্ষায় ফেল করানো,ক্লাশে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।এছাড়া অবিবাহিত শিক্ষক তৃষানের বিয়ে না করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেছেন শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা অমান্য করে কোচিং ব্যবসার ফলে শিক্ষার্থীরা ফলাফলে ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

ফ্যাসিবাদের দোসর বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এহতেশামুল হক কলেজটিকে ফ্যাসিস্টদের আখড়া হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমন্ত্রিত শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করেন। বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর সুপারিশে কে এম মাহারুজ ইসলাম তৃষানকে আমন্ত্রিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন অধ্যক্ষ। এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগের আগে থেকেই কোচিং বানিজ্যের সাথে জড়িত ।

বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সুনাম ও সুখ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে কোচিং ব্যবসা জোরদার করেন এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান নামের এই শিক্ষক।তিনি এডু কেয়ার কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত।বাড়তি আয় রোজগার হিসেবে বাসায় স্থাপন করেছেন কোচিং ব্যবসা।তৃষানের রয়েছে বড় এক সিন্ডিকেট।যারা ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর কাজ করে যাচ্ছেন।তৃষানের বিয়ের বয়স হলেও এখনো বিয়ে করেনি।অবিবাহিত এই শিক্ষকের ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের।

তৃষানের কোচিং সেন্টার
তৃষানের কোচিং সেন্টার

এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান শিক্ষকতার আড়ালে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে করে যাচ্ছেন একের পর এক অপরাধ।তার এই অপরাধ জগত নিয়ে কথা বললেই ফাঁদ পাতেন। সব সময়ই তিনি সফল হন।তিনি স্বিকার করেছেন বিয়ে করেন নি।এও স্বিকার করেছেন তিনি এডুকেয়ার কোচিং সেন্টার ও বাসায় কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তৃষানের কোচিং ব্যবসার মুখোশ উন্মোচন করেছে অভিভাবকরা। এই অভিযোগ উঠেছে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজকে ঘিরে, যেখানে অভিভাবকরা দাবি করেছেন, প্রতিষ্ঠানটির খন্ডকালীন শিক্ষক তৃষান শিক্ষার্থীদের জোর করে কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য করে এবং যারা কোচিং করে না, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন।

শিক্ষাবিদ সায়েদুজ্জামান বলেন,দীর্ঘদিন ধরে শিশু শিক্ষা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই অভিযোগগুলো কোনো কল্পকথা নয়। দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, অনেক শিক্ষক ক্লাসে পূর্ণাঙ্গ পাঠদান না করে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। এই প্রবণতা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করছে। অনেক শিক্ষক সচেতনভাবে ক্লাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়ান না, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে টিউশন করতে বাধ্য হয়। যারা প্রাইভেট পড়ে, তাদের ক্লাসে সহজ প্রশ্ন করে প্রশংসা করা হয় আর যারা পড়ে না, তাদের জটিল প্রশ্ন করে বিব্রত করা হয়। এই বৈষম্যমূলক আচরণ শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আঘাত করে, তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে এবং শিক্ষকের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ কমিয়ে দেয়।

এই সমস্যা এতটাই গভীর যে, কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জন্য সরকার ২০১২ সালে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছিল। এই নীতিমালায় স্পষ্ট বলা হয়েছিল, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না; শুধু প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন এবং তাদের তালিকা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে জমা দিতে হবে। নীতিমালার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষকের পেশাগত নৈতিকতা রক্ষা করা। কিন্তু এই নীতিমালা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের তদারকি দুর্বল ছিল, ফলে এটি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।

২০১৯ সালে এই নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় এবং ২০২২ সালে নতুন শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা বা পরিচালনা করা অপরাধ নয়, তবে শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং বা প্রাইভেটে পড়াতে পারবেন না। এছাড়া, অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হলে তা সরকার নির্ধারিত ফি এবং অভিভাবকের সম্মতিতে করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই নির্দেশনা মানা হয় না। বরং তৃষানের মত শিক্ষকরা ক্রমশ প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে আরও বেশি ঝুঁকছেন।

এ ব্যাপারে এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান বলেন,আমি অবিবাহিত এটা ঠিক। এডুকেয়ার এর কোচিং ও নিজ বসায় কোচিং সেন্টার খোলার কথা স্বিকার করেন তৃষান।তিনি বলেন, আমি খন্ডকালীন শিক্ষক তাই সরকারি আইন আমার জন্য প্রজোয্য নয়।তবে কোচিং করার বিষয়টি অধ্যক্ষ জানেন।

এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুন বলেন,এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান আমার থেকে বা কলেজ থেকে কোচিং করানোর অনুমতি নেয়নি।তিনি বলেন কোচিং এটা আইন বিরোধী।আমি আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, তৃষানসহ শিক্ষকদের কোচিংয়ের কারণে শিশুরা বহুমুখী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রথমত, শারীরিক ও মানসিক চাপ; সকালে স্কুল, তারপর কোচিং—এভাবে সারাদিন ব্যস্ত থাকায় শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খেলাধুলা, বিশ্রাম বা সৃজনশীল কার্যক্রমের সুযোগ কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি শিশুদের শারীরিক বিকাশে বাধা দেয় এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাস হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সৃজনশীলতা হ্রাস; অতিরিক্ত কোচিংয়ের কারণে শিশুরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শেখার সুযোগ পায় না, যা তাদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে দমিয়ে দেয়। তৃতীয়ত, বৈষম্য; যেসব অভিভাবক অর্থনৈতিক কারণে কোচিংয়ে সন্তান পাঠাতে পারেন না, তাদের সন্তানরা ক্লাসে উপেক্ষিত হয় এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ধনী-গরিব বিভাজন আরও তীব্র হয়।
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টার শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে বাণিজ্যিক লক্ষ্যে রূপান্তরিত করছে। অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাসকে অবহেলা করে কোচিং সেন্টারে বেশি সময় দেন, কারণ এটি তাদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। এর ফলে স্কুলের পাঠদান দুর্বল হয় এবং শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।অভিভাবকরাও এই সমস্যার একটি অংশ। কিছু অভিভাবক সন্তানের ভালো ফলাফলের আশায় নিজেরাই কোচিংয়ে পাঠাতে উৎসাহী হন, আবার অনেকে শিক্ষকের চাপ বা সামাজিক প্রত্যাশার কারণে বাধ্য হন। এর ফলে কোচিং ব্যবসা আরও বিস্তৃত হয়। তবে অনেক শিক্ষিত ও স্বচ্ছল অভিভাবক সন্তানকে বাড়িতে পড়াতে চান, কিন্তু শিক্ষকের অবহেলার কারণে তারা সন্তানের ফলাফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোচিং সেন্টার থাকতে পারে, তবে তা শুধু বহিরাগত শিক্ষার্থীদের জন্য। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এই আইন প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া, সরকারি পর্যায়ে শক্তিশালী মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে, যারা অকস্মাৎ পরিদর্শন করে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহ ও শাস্তি নিশ্চিত করবে।

আরেক অভিভাবক বলেন,বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজটিতে ছাত্রী রয়েছে।অবিবাহিত শিক্ষকদের উচিৎ বিয়ে করে শিক্ষকতা করা।তৃষানের ব্যাপারে অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলেছেন বিবাহযোগ্য হলেও কেন তৃষান স্যার বিয়ে করেন না? ।

শিক্ষা অফিস সুত্র জানিয়েছে,শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে পড়ানো ভালো ফলাফলের একমাত্র পথ নয়—এই বোধ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিশ্রামের সুযোগ সমানভাবে প্রয়োজনীয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য নির্মূল করা শুধু শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নয়, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। আজ যদি আমরা এই সংস্কার না করি, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু বইয়ের বোঝা বহন করতে করতে সৃজনশীলতা ও নৈতিকতা হারাবে। শিক্ষা ব্যবসায় পরিণত হবে, শিক্ষক ব্যবসায়ী হয়ে উঠবেন, আর শিক্ষার্থী হবে একটি অবিরাম প্রতিযোগিতার যন্ত্র—যেখানে মানবিকতা, আনন্দ ও প্রকৃত শিক্ষার কোনো স্থান থাকবে না।তাই এখনই সময় কঠোর আইন, সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বয়ে কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরার। শিশুদের জন্য, শিক্ষার জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য।

উল্লেখ্য, কে এম মাহারুজ ইসলাম তৃষান মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লেংগুটিয়া গ্রামের মোঃ হারুন অর রশিদের পুত্র।২০২২ সালে বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর সুপারিশে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.