চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ বৃদ্ধি ও বিদেশিদের কাছে টার্মিনাল ছেড়ে দেওয়া নিয়ে বিতর্ক কেন?

বিবিসি : চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর মাশুল বা ট্যারিফ ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ডিসেম্বর মাসেই নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। বিদেশিদের সুবিধা করে দিতেই ট্যারিফ বাড়ানো হলো কি না এমন সমালোচনাও হচ্ছে।
জানা যাচ্ছে, নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং লালদিয়ার চরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে ডেনিশ কোম্পানি এপি মোলার মায়ার্স বা এপিএম।
এর মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি বর্তমানে চালু রয়েছে। অন্যদিকে নতুন টার্মিনালটি হবে কর্নফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চর।
টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের প্রস্তুতির মধ্যে বন্দর ব্যবহারে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এই বর্ধিত মাশুল নিয়েও ঘোর আপত্তি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
তাদের অভিযোগ, বিদেশি কোম্পানিকে বাড়তি সুবিধা দিতেই সরকার মাশুল বাড়িয়েছে। এছাড়া লাভজনক একটি চালু টার্মিনাল কেন বিনা দরপত্রে বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হবে সেই প্রশ্নও উঠছে।
চালু টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিক কর্মচারীসহ একটি অংশের বিরোধিতা করছে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কর্মসূচিও পালিত হয়েছে।
তবে সরকার বলছে বন্দরের আধুনিকায়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ট্যারিফ বাড়ানোর সঙ্গে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি কর্তৃপক্ষের।সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বর মাসেই বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের চুক্তি সম্পাদন হতে পারে। এই চুক্তি ২৫-৩০ বছর মেয়াদী হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা কী বলছেন
বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া ও একই সঙ্গে ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বন্দর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান ট্যারিফে বন্দর বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার পরেও ট্যারিফ বৃদ্ধি কার স্বার্থে সেই প্রশ্ন উঠেছে।”তিনটা টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়া হবে। এখন সবাই এটা যোগ করছে যে ওদেরকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এই ট্যারিফটা বাড়ানো হয়েছে। তা না হলে বাড়ানোর দরকারটা কী? লাভ তো করছে সরকার।”
চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নেতা আমিরুল হক বলেন, বিদেশি কোম্পানির জন্য ট্যারিফটা বাড়ানো ঠিক হয়নি।”এটা না হলে তো তারা টার্মিনাল করতে আসবে না। আপনি কাউকে টার্মিনাল দেওয়ার জন্য যদি ট্যারিফ বাড়ান এর থেকে গর্হিত কোনো কাজ হতে পারে না। এফিশিয়েন্সি বাড়াবেন, সাথে সাথে কস্ট অফ ডুইং বিজনেসটাও কিন্তু কমাতে হবে।অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ মাশুল বৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, শতকরা ৪১ ভাগ মাশুল বৃদ্ধি কী কারণে করা হচ্ছে এটা একটা প্রশ্ন, “আমরা জানি মাশুল বৃদ্ধির বড় ধরনের একটা চেইন ইফেক্ট আছে”।”মাশুল বাড়ালে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়বে। রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা কমবে। জিনিসপত্রের দামের ওপরে তার প্রভাব পড়বে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে যেটার কোনো যুক্তি নাই। শুধুমাত্র বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ দেখা ছাড়া আর কোনো যুক্তি নাই”।এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, মাশুল বৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই।
“২০১৯ সাল থেকে কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয় মাশুল পুনর্বিন্যাস করার জন্য। আমাদের ট্যারিফটা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। এরপর ৩৯ বছর এখানে আর কোনো ট্যারিফ রিভাইজড হয় নাই”, জানান তিনি।তবে ৩৯ বছরে ট্যারিফ বাড়েনি এটা সত্যি না দাবি করে ব্যবসায়ী নেতা আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, “বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বাড়ানো হয়েছে। ঢালাওভাবে একসঙ্গে না। এটা এক নম্বর।”
“দ্বিতীয় কথা তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক যেটা হয়েছে সেটা ডলার রেইট। ওইসময় ছিল ৩০ টাকা ৬১ পয়সা। এখন সেটা বাড়তে বাড়তে ১২২ টাকায় এসেছে। ৪০০ পার্সেন্টের ওপরে বেড়েছে. সেই বেনিফিট তো সরকার পেয়েছে। যেজন্য প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার ওপর পোর্ট লাভ করেছে”।১৫ই অক্টোবর থেকে কার্যকর হলেও আন্দোলনের মুখে কিছু ক্ষেত্রে মাশুল স্থগিত করা হয়েছে।
তবে পুরো ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গে বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “এটা এখন সরকারের হাতে। আমরা এটা নিজেরা কিছু করতে পারি না। যেহেতু গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে গেছে এটা চট্টগ্রাম বন্দর চাইলেই এটা চেঞ্জ করতে পারবে না। সরকার যদি কোনো রকম বিবেচনা করে সেটা করতে পারে।
আরো চার টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর
চট্টগ্রাম বন্দরের চালু থাকা নিউমুরিং টার্মিনালসহ ভবিষ্যতে নতুন তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হবে।
“এপিএম আলাদা একটা টার্মিনাল করছে লালদিয়ার চর। তাদের আমরা প্রায় ৩৫ একরের মতো জায়গা আমরা দিয়েছি। সেটা তারা বিল্ড, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার পদ্ধতিতে নিজস্ব টার্মিনাল করবে এবং নিজেরা হ্যান্ডেল করবে। একটা সার্টেন পিরিয়ডের পর তারা বন্দরকে ট্রান্সফার করবে। বে টার্মিনালে যেটা হবে, বে টার্মিনালে ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ এদের জিটুজি ভিত্তিতে ওরা পিপিপি অথরিটির মাধ্যমে কাজ করবে,” বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান।
বে টার্মিনাল প্রকল্পে একটা মাল্টিপারপাজ কনটেইনার টার্মিনাল হবে, চট্টগ্রাম বন্দর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এই টার্মিনালটা নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছে।
বর্তমানে চালু নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর আসলে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে বা নতুন কোন ধরনের সুবিধা হবে সেটি চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে জানান বন্দর সচিব।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি বা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনা বেশ পুরোনো–– জানিয়েছেন মো. জাফর আলম, যিনি চট্টগ্রাম বন্দরে প্রশাসন ও পরিকল্পনা সদস্য পদে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
তিনি জানান, ২০১৭-১৮ সালের দিকে ডিপি ওয়ার্ল্ড সরকারকে এই পরিকল্পনা দিয়েছিল। তখন তাদের প্রস্তাবে বলা হয়–– এনসিটিতে বিনিয়োগ করবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ফ্রেইট কোরিডোরকে আরো স্মুথ করবে।
“এছাড়া আমাদের রেলওয়েতে খুব কম পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা হয়, কারণ কমলাপুর আইসিডির ক্যাপাসিটি খুব কম। তাদের প্রস্তাব ছিল ধীরাশ্রমে একটা আইসিডি করবে এবং পুবাইল থেকে একটা লুপ লেইন এগারো কিলোমিটার ধীরাশ্রম যাবে সেখানে কনটেইনারগুলো নামাবে।”
“বন্দর তখনই এফিশিয়েন্ট হবে যখন তার পশ্চাদভূমির সঙ্গে ডেডিকেটেট সংযোগ হয় বা কানেকটিভিটি থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এটা নেই। এই প্রস্তাবটাও ডিপি ওয়ার্ল্ড দিয়েছিল। এই তিনটা একসাথে। এখন এনসিটি যদি শুধু ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া হয়, আর অন্যগুলোকে অ্যাড্রেস না করা হয় তাহলে কিন্তু খুব একটা লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।”
বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা প্রসঙ্গে মো. জাফর আলম বলেন, বন্দর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এমন সমালোচনা হয়। আসলে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ মানেই বন্দর বিক্রি করা না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ভেঙে দেখলে একটি জাহাজ আসবে, দেশের সীমানায় ঢুকবে, ওখান থেকে আউটার অ্যাঙ্করেজে আসবে, তারপরে ভেড়ার পরে কেবল কনটেইনার নামানোর কাজটাই হলো অপারেটরের কাজ।
“গ্রিনফিল্ড (নতুন নির্মাণ) টার্মিনাল আমাদের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এনসিটির মতো টার্মিনাল যদি আমরা দেই অনেক হিসেব নিকেশ করে দিতে হবে। কারণ ওখানে আমাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। এবং যদি এই হিসেব নিকেশে ভুল হয় তাহলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে,” বলেন মি.আলম।
ব্যবসায়ী নেতা আমিরুল হক বলেন, ব্যবসায়ীরা টার্মিনাল প্রাইভেট অপারেটরদের কাছে দেওয়ার বিপক্ষে না।
“আপনি বলতে পারেন যে কোম্পানিটা হবে সেটার ৪০ শতাংশ স্টেক থাকবে বাংলাদেশি নাগরিকরা। বাংলাদেশি ছাড়া কেউ কিনতে পারবে না। কোনো কোম্পানি না। আপনি বলবেন এটা শেয়ার মার্কেটে যাবে।”
“আমাদের বিদেশি অপারেটর দরকার ছিল অনেক আগে থেকে। আপনি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দিতে চান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে। কী বেসিসে দেবেন? দেশের স্বার্থও দেখতে হবে। আবার এটাও দেখতে হবে আপনি যাকে টার্মিনাল অপারেটর নিযুক্ত করেছেন সে যদি আপনার সাথে বৈরিভাবাপন্ন দেশের কোনো অপারেটরের কাছে ওই অংশটা বিক্রি করে দেয় তখন আপনি কোথায় যাবেন?”
চালু টার্মিনালে নতুন অপারেটর নিয়োগ পেলে কী ধরনের সুবিধা হবে এবং নতুন কী পরিবর্তন আসবে এমন প্রশ্নে বন্দরের সচিব বিবিসি বাংলাকে বলেন,
“এটা সরকারি সিদ্ধান্ত আমরা এখানে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। যেহেতু সরকারের একটা জিটুজি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এটা হচ্ছে, তো যদি গ্লোবাল অপারেটর আসে আমাদের এখানে একটা ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার আছে। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজারের সাথে তাদের যে নেগোসিয়েশন হবে সেখানে আসলে সবগুলো বিষয় উল্লেখ থাকবে। কী কী পরিবর্তন তারা আনবেন, কী কী ফেসিলিটিজ এখানে প্রোভাইড করবেন কীভাবে চার্জ নেবেন সবকিছু সেখানে উল্লেখ থাকবে। এটা দেখতে হবে নেগোসিয়েশন ফেইজটা কীভাবে হয় ফাইনালি চুক্তির পরে এটা বলা যাবে।
বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রশ্নে বিতর্ক ও বিরোধিতা
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। আঞ্চলিক ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও এ বন্দর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে।এ বন্দর নেপাল ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যত আমদানি-রপ্তানি হয় তার ৯২ শতাংশ এই বন্দর দিয়ে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে মোট কনটেইনার ওঠানামার ৯৮ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে।চট্টগ্রাম বন্দরে গত অর্থবছরে তিন মিলিয়ন কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে যা ৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে।এই সম্ভাবনা ও সুযোগ কাজে লাগাতে বিদেশি বিনিয়োগ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন ।
তবে বিদেশি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়াটাই চূড়ান্ত সমাধান নয় বলে মনে করেন এর বিরোধীতাকারীরা।বাংলাদেশে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব আনুম মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। এই বন্দর দক্ষ না, এই বন্দরের সক্ষমতা নাই- এই কথাটা ঠিক না। কারণ যথেষ্ট লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এ বন্দর।
“আরেকটা কথা হচ্ছে অপারেটিংয়ে মাল আনা-নেওয়ায় সময় লাগে বেশি। সময় লাগে এটা অপারেটরের জন্য না। সময় লাগে কাস্টমসের জন্য, আমলাতন্ত্রের জন্য এবং সময় লাগে বেশি যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য”।
আরেকটা প্রাকৃতিক আছে যেহেতু গভীর সমুদ্র বন্দর না সুতরাং জোয়ার ভাটার জন্য সমস্যা। সুতরাং অপারেটর পরিবর্তন করলে এগুলোর কোনোটারই পরিবর্তন হবে না, মনে করেন আনু মুহাম্মদ।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বিরোধিতায় সরব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ চারটি কারণ উল্লেখ করেন। তার ভাষায়,
প্রথমত, এখানে ভৌগোলিক যে সমস্ত অবস্থা আছে–– চীন, যুক্তরাষ্ট্র ভারত একটা অংশ আছে তাদের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সেগুলোর মধ্যে তো আমরা পড়তে চাই না। সেজন্য বন্দরের কর্তৃত্বটা আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত।
“দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে কোনো যুক্তি নাই। বন্দর লাভজনকভাবে চলছে।
তৃতীয়ত, জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চললে সব পর্যায়ে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির যে সুযোগ থাকে বিদেশি কোম্পানির হাতে গেলে সেটা থাকে না।
চতুর্থত, বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিকে একটা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে আমাদের খেয়াল করতে হবে যাতে রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বেশি থাকে, প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বেশি থাকে।
“আমদানি পণ্যের দাম যেন অপ্রয়োজনে বৃদ্ধি করে সারাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি না করে এই সমস্ত বিবেচনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব যদি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে জাতীয় বন্দর থাকে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি কোম্পানি রেডসি গেটওয়ে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেয় বিগত সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারও দরপত্র ছাড়াই এনসিটির পাশাপাশি ভবিষ্যতে বে টার্মিনালে প্রকল্পে আরো দুটি টার্মিনালে নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব ডিপি ওয়ার্ল্ড ও সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনকে দেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা বহাল রেখেছে বলে অভিযোগ।
বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোনো চুক্তি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে হওয়া দরকার বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী নেতা আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার যদি দ্রুত ও মানসম্মত সেবার জন্য বিদেশিদেরআনতে চায় তবে টেন্ডার করে আনুক।
“আমাদের কথা হলো টেন্ডার করে দেওয়া হোক। টেন্ডারে আপনি প্রাইসটাও ভালো পাবেন। বাছাই করতেও সুবিধা হবে হু আর দ্য বেটার অপারেটর। সরকার বলছে বিশ্বসেরা কোম্পানি নিয়ে আসছে। কিন্তু আপনি যে রেইট করছেন এই রেটের জন্য আপনি বাংলাদেশের লোকের পকেট কেটে ফেলছেন এটা কেমন হলো? এই যে ৪১ পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেওয়া হলো, কারণ ওরা লাভ করবে।”
সরকারের দাবি, বন্দর পরিচালনায় বিশ্ব সেরা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানি আসলে নতুন বিনিয়োগ হবে, বন্দরে গতি বাড়বে, সক্ষমতাও বাড়বে। বিদেশি অপারেটর ছাড়া বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় নেই।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারের এই অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন, সরকার কোনো সমালোচনা শুনছে না, একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আলোচনায় যেতেই চাচ্ছে না।
“একতরফাভাবে করতে হবে এবং একতরফাভাবে আমরা যাকে ভালো বুঝি সেই সবচেয়ে ভালো, আমরা যেটা করবো সেটাই দেশের জন্য ভালো–– এই যে দৃষ্টিভঙ্গী এটাই স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গী। এটাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।”
আনু মুহাম্মদ বলেন, “নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটা ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা টেন্ডার ছাড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখানে একটা প্রশ্ন এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার কোন তাগিদে কী যুক্তিতে শেখ হাসিনার অসমাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে এত অস্থির?”
‘অস্থির’ বলতে তিনি যারা প্রতিবাদ করছে তাদের পুলিশ দিয়ে হুমকি ও দমন করার চেষ্টার কথা বলেন।
“তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) কি কোথাও কোনো দায়বদ্ধতা আছে তাদের যে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিতেই হবে কিংবা কোনো মুচলেকা দেওয়া আছে কোথাও? এই প্রশ্নটা আমাদের মাথায় আসছে। এই প্রশ্নের জবাবতো আমাদেরকে দিতেই হবে সরকারকে, আজ হোক কাল হোক”।
অতীত সরকারের ধারাবাহিকতায় দরপত্র ছাড়াই নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন এবং অভিযোগ নিয়ে নৌ পরিবহন উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার চাইলে বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।



