সম্পাদকীয়

নুর আর কত মার খাবেন?

prothomalo bangla 2023 08 4628837a 1d27 4e9d a776 6dacc5453a03 Nur pic
print news

রাজপথে ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়ার রেকর্ড তিনি আগেই ভেঙেছিলেন। ২০২১ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষে ২০তম বার হামলার শিকার হওয়ার পর তাঁর বারবার মার খাওয়া-পড়ে যাওয়া-উঠে দাঁড়ানো নিয়ে ‘নুরুলের বিংশতিতম মার খাওয়ায় কার ক্ষতি কার লাভ’ শিরোনামে একটি কলামও লেখা হয়েছে। দুঃখের বিষয় একই প্রসঙ্গে আবার লিখতে হচ্ছে।

সন্দেহ নেই, প্রতিপক্ষ প্রবল জেনেও বুক টান করা এবং মার খেয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর দুর্লভ সাহস নুরুল হক নুরকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের মাঝে উত্তরোত্তর জনপ্রিয় করেছে। একেকটি হামলা নুরের নেতৃত্বের মুকুটে একেকটি অর্জনসূচক পালক হিসেবে প্রোথিত হয়েছে।

হয়তো সে কারণেই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ নুরকে মারতে মারতে ভিপি বানিয়ে দিল!’
তো, সেই নুরুল হক নুরের ওপর গত বুধবার আবার হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এলোপাতাড়িভাবে তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের কিল-ঘুষ-লাথি মারা হয়েছে। আমার হিসাবে এই নিয়ে এটি তাঁর ওপর চালানো একবিংশতিতম হামলা। এই হামলায় তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় এখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে।

খেয়াল করার বিষয় হলো, মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে নুরুল হকের বাড়িতে ডিবি পুলিশের তল্লাশি চালানোর পর বুধবার বিকেলে হামলার মুখে পড়েন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়ানো ভিডিওচিত্রে দেখা যাচ্ছে, গভীর রাতে নুর ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে উচ্চস্বরে তর্ক করছেন; তাঁর চেহারায় কোনো ভীতি বা আতঙ্কের ছাপ দেখা যাচ্ছে না।এরপর বুধবার বিকেলে এই হামলা হয়। একাধিক দফায় তাঁকে ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। নুরসহ গণ অধিকার পরিষদের ২০ জনের বেশি নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

অপ্রিয় সত্যটি হলো, মার না খেলে বঙ্গ রাজনীতিতে পোড় খাওয়া রাজনীতিক হিসেবে কল্কে পাওয়া দুষ্কর। আর সেই অর্জনের পথে নুরকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে ছাত্রলীগ। নুরের জীবন বার বার বিপন্ন হয়েছে। বার বারই তার জেরে তাঁর রাজনৈতিক ভিত পূর্বাপেক্ষা শক্ত হয়েছে।

রণক্ষেত্রে ব্যবহার্য শিরস্ত্রাণের মতো করে হেলমেট মাথায় দিয়ে কথায় কথায় হাত-পা-লাঠি চালনার মাধ্যমে ছাত্রলীগ গত কয়েক বছরে যে আগ্রাসী ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, তা আতঙ্কজাগানিয়া। মারমুখী ছাত্রলীগ প্রতিবারই নূরুল হকের বক্তব্য, ভাষাভঙ্গি ও শারীরিক অভিব্যক্তির ঔদ্ধত্য স্তিমিত করতে এবং তাঁর চেহারায় ভয়ের রেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নূরের নিঃশঙ্ক চেহারা ছাত্রলীগকে হতাশ এবং তাঁর অনুসারীদের উজ্জীবিত করেছে। কোনো দলের পক্ষে সক্রিয়ভাবে জড়িত নন এমন অনেক মানুষ নুরের দুর্লভ সাহসিকতার কারণে তাঁর প্রতি সমব্যথী হয়েছেন; তাঁকে নৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন।
তবে সম্প্রতি নুরুল হক নূরের বিরুদ্ধে ওঠা দুটি অভিযোগ তাঁর জনসমর্থনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একটি অভিযোগ হলো, কথিত ইসরায়েলি এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন।

এই অভিযোগের বিষয়ে নুর একাধিকবার সাফাদি নামের কাউকে চেনেন না বলে দাবি করলেও তাঁর নিজের দলেরই একটি অংশ কথা বিশ্বাস করেনি। তারা মেন্দি সাফাদির সঙ্গে নুরের বৈঠক হয়েছে—এমন দাবির স্বপক্ষে যুক্তি–তর্ক তুলে ধরেছেন। ফলে সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে নূরের দেওয়া ভাষ্য ধোঁয়াশাপূর্ণ থেকেই গেছে।

দ্বিতীয়টি অভিযোগটি হলো, দলের জন্য চাঁদা হিসেবে তোলা অর্থের সর্বজনগ্রাহ্য ও সন্তোষজনক হিসাব দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। গত দুই বছরে তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আর্থিক অবস্থার দৃশ্যমান উন্নতির পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি খোলাখুলিভাবে নিজের আর্থিক অবস্থা ব্যাখ্যা করেননি।
এই বিষয় নিয়ে আমার লেখা ‘এ কোন নূর, একে তো আমরা চিনি না’ শিরোনামের একটি কলাম প্রকাশিত হওয়ার পর নূর ও তাঁর সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, ওই লেখায় নুরের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রকাশ্য সমাবেশে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইভ অনুষ্ঠানে লেখাটি নিয়ে নূর তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেই ক্ষোভ প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর আছে।

অভিযোগগুলো ওঠার পর থেকে নুর বলে আসছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে খাটো করার উদ্দেশে করা হয়েছে। নিজের প্রতিবাদী কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি নিজের স্বচ্ছতা জনগণের সামনে প্রমাণ করবেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন সমর্থন করে তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা মিছিল-সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। এর মধ্যে বুধবার বিকেলে তিনি হামলার মুখে পড়লেন।
এই অতি নিন্দনীয় হামলায় ছাত্রলীগের সহিংস চেহারাটাই সামনে এসেছে। এতে জনমানসের বিরক্তি ছাত্রলীগের দিকে এবং নৈতিক সহানুভূতি নুরের দিকে যাওয়া স্বাভাবিক। যদিও ছাত্রলীগ জনমানসের নৈতিক সমর্থনের বিষয়টিকে কতটা পরোয়া করে তা তর্কসাপেক্ষ বিষয়।

কিন্তু এর মধ্যে যে প্রশ্নটি এখন উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি মেরে যাচ্ছে, সেটি হলো: মেন্দি সাফাদি ও আর্থিক হিসাব সংক্রান্ত অভিযোগ ওঠার আগের দিনগুলোতে নূরুল হক নুর ছাত্রলীগের একেকটি হামলার মুখে পড়ে সাধারণ মানুষের যে নৈতিক সমর্থন পেতেন, অভিযোগ ওঠার পর এখন কি ঠিক আগের মতোই জনসহানুভূতি তাঁর পক্ষে যাচ্ছে? যেহেতু গণতন্ত্রে দিন শেষে জনগণের নৈতিক সমর্থন ও সহানুভূতি রাজনীতিকদের প্রধান পুঁজি ও অবলম্বন, সেহেতু এই প্রশ্নের জবাবের ওপর নুরুল হকের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করছে।

তবে সবকিছুর ঊর্ধে মানুষের মানবিক সত্ত্বা। নুরুল হকের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তাঁর ওপর এই হামলার অকুণ্ঠ নিন্দা জানিয়ে রাখছি। শারীরিকভাবে হামলা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ—সেই বিবেচনায় হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। নুরের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *