বিশেষ সংবাদ

টিসিবিতে ২৯৭ কোটির অনিয়ম দুই বছরে

d4122620d17eca9759bccc5b0260f8bf 64cf1db89348f
print news

উৎসে ভ্যাট না কাটায় ক্ষতি ৮৮ কোটি টাকার।
রংপুর অফিসে ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ।
উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি কোষাগারে না দিয়ে আইন লঙ্ঘন।

অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে নিত্যপণ্যের বাজার যখন অস্থির হয়ে ওঠে, তখন বাজারে ভারসাম্য ফেরাতে এগিয়ে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিতরণ করে সর্বসাধারণের আস্থায় আসা এই প্রতিষ্ঠানেও অনিয়ম-দুর্নীতির থাবা পড়েছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯৭ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে টিসিবিতে।

‘ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাবসম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ পায় চলতি বছরের শুরুর দিকে। এতে উঠে আসা টিসিবির অনিয়মের মধ্যে রয়েছে গুদামের পণ্যের টাকা আত্মসাৎ, বকেয়া পাওয়া আদায় না করা, সরকারি কোষাগারে টাকা জমা না করা, পণ্য সরবরাহ না নিয়ে বিল পরিশোধ ও উৎসে কর আদায় না করা।

টিসিবির নানা অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টিসিবি জনস্বার্থে কাজ করে আসছে। জনগণের টাকায় পরিচালিত এই সংস্থায় কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তা উদ্বেগজনক। এ ক্ষেত্রে টিসিবি একটি-দুটি মামলা করে দায় এড়াতে পারে না। এটি একধরনের প্রতারণা। প্রতারণা ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা অনিয়মের বড় একটি ক্ষেত্র ছিল টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে দুর্নীতি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা ও পেঁয়াজ বিক্রির ২ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ৩৩৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই ঘটনায় তৎকালীন অফিসপ্রধান সুজা উদ্দৌলা সরকার, গুদাম কর্মকর্তা মেসবাহুল সালেহীন এবং নিরাপত্তা প্রহরী মোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গুদাম কর্মকর্তার একক স্বাক্ষরে ২৬৭টি সরবরাহ আদেশে (ডিও) ইস্যু করা হয়। ডিও রেজিস্টারে ২ হাজার ৮৬৩টি তালিকা করা হয়েছে। আর প্রকৃত ডিও পাওয়া যায় ৩ হাজার ১৯২টি। আর্থিক ব্যবস্থাপনা নীতি (জিআরএফ) অনুযায়ী, ভান্ডারের হিসাব সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় দুই কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর কাছ থেকে দাবি করা টাকা আদায় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের টিসিবি কর্মচারী প্রবিধানমালার আওতায় ও প্রচলিত আইনে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও আত্মসাৎ করা টাকা আদায় হয়নি।

অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সুজা উদ্দৌলা সরকার বলেন, ‘তৎকালীন ভান্ডার কর্মকর্তা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। আমার স্বাক্ষর জাল করে পণ্য তুলেছেন। ভান্ডার কর্মকর্তা আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।’ গুদাম কর্মকর্তা মেসবাহুল সালেহীন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদন ছাড়া কিছুই হয়নি। নিজেকে বাঁচাতে একজন অপরজনকে দোষারোপ করে। কে কী অনিয়ম করেছে, সামনাসামনি কথা হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

ভবন নির্মাণে অনিয়ম: টিসিবির প্রধান কার্যালয় ভবনের ১০-১১ তলা সম্প্রসারণকাজের বিভিন্ন মালপত্র স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ করেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এরপরও প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়মের মাধ্যমে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ৪০৫ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, নিরীক্ষকেরা নিজেদের মতো করে কথা বলে। এখানে অনিয়ম আদৌ হয়েছে কি না, সেটি সরেজমিন এসে দেখতে পারেন। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই। এতে কোনো অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।

আইন লঙ্ঘন করে সংস্থার হিসাবে স্থায়ী আমানত: স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০ এর ৪(২) ধারায় বলা আছে, তফসিলভুক্ত কোনো সংস্থা আপৎকালীন ব্যয়ের জন্য যুক্তিসংগত পরিমাণ টাকা, যা বার্ষিক পরিচালন ব্যয়ের ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ টাকার অতিরিক্ত হিসাবে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে। ধারা ৫(ক) অনুযায়ী, অতিরিক্ত টাকা অবিলম্বে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে।

কিন্তু টিসিবি আইন লঙ্ঘন করে উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে সংস্থার বিভিন্ন তহবিলে জমা রেখেছে। এতে রাষ্ট্রের প্রায় ১৯১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, অর্থ নিজ কোষাগারে রাখায় অনিয়ম হয়েছে। তবে টিসিবি নিজস্ব অর্থে পরিচালিত হয়। এই টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোষাগারে জমা দেওয়া হলে তা আবার ফিরিয়ে আনা কঠিন। টিসিবির যেসব আপত্তি রয়েছে, সেগুলো ত্রিপক্ষীয় সভায় সমাধা করা হবে।

বকেয়া পাওনা আদায়ে গড়িমসি: নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ বীমা করপোরেশন, কাস্টমস, সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি, বাংলাদেশ কনজ্যুমারস সাপ্লাই করপোরেশন, সংস্থার বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ের কাছে টিসিবির ১২ কোটি ৬৮ লাখ ৬৩ হাজার ৯৫৫ টাকা পাওনা বকেয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব বকেয়া আদায় করতে না পেরে জিএফআর এর ৩০ বিধি লঙ্ঘন করেছে টিসিবি।

উৎসে ভ্যাট না কাটায় ৮৮ কোটি টাকার ক্ষতি: টিসিবির কেনা ভোগ্যপণ্যের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট না রেখেই সরবরাহকারীকে বিল পরিশোধ করা হয়। উৎসে কর না রেখেই ১ হাজার ১৮৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর না রাখায় এতে সরকারের ৮৮ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৪ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৯ সালের অর্থ আইন ও ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

কম হারে উৎসে কর নেওয়া: ২০২০ সালের অর্থ আইন ও ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ ডিলারদের কাছে পণ্য বিক্রির পর ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ হিসেবে উৎসে কর নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নেওয়া হয়েছে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৪৭৩ টাকা।

জানতে চাইলে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান বলেন, অডিটের লোকজন তাঁদের মতো করে হিসাব করেন। প্রতিটি ঘটনার পেছনে কারণ রয়েছে। টিসিবির নিজস্ব অর্থে চলতে হয়। দু-একটি অনিয়মের বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *