শুধু অঙ্গীকার নয়, প্রতিপালনও করতে হবে


এমএ হালিম
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, আহত হচ্ছে, চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ বিপুলসংখ্যক মানুষের সিংহভাগই বেসামরিক, যারা যুদ্ধ বা হানাহানির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। তথাপি যুগে যুগে সংঘটিত যুদ্ধ অথবা হানাহানিতে বেসামরিক মানুষই বিবদমান সৈন্য বা পক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়।
যুদ্ধ বা হানাহানি অথবা বিভিন্ন মানবিক সংকটের শিকার মানুষকে সাহায্য করার জন্য রেড ক্রসসহ বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা নিবেদিত। এসব সংস্থা ও সংস্থার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে মানবিক সেবার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনহানিও ঘটে।
২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট ইরাকের বাগদাদে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত Sergio Vieira de Melloসহ ২২ জন মানবিক কর্মী আততায়ীর হাতে নিহত হন। এ দিনটিকে স্মরণ করা, নিহতদের প্রতি সম্মান জানানো ও মানবিক কর্মীদের অনুপ্রেরণা জানাতে ২০০৯ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মানবিক দিবস (International Humanitarian Day) হিসাবে ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবিক দিবস। এ দিনটি পালনের লক্ষ্য হচ্ছে মানবিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সম্মান সুসংহত করা।
বাংলাদেশে যুদ্ধ না থাকলেও কখনো কখনো এমনসব আকস্মিক ঘটনা ঘটছে, যা অমানবিক। যুগান্তরে প্রকাশ, বুধবার মাদারীপুরের শিবচরে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে সাবেক স্বামী এসিড নিক্ষেপ করে মুখ ও শরীর ঝলসে দিয়ে পালায়। আর একটি পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। অন্য একটি পত্রিকার খবর, ১৪ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে নির্বাচনি বিরোধের কারণে এক ব্যক্তিকে পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। আর একটি পত্রিকায় প্রকাশ, ১৬ আগস্ট নড়াইলে পাট কাটা নিয়ে তুচ্ছ ঘটনায় এক কৃষককে হত্যা করা হয়েছে।
এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন, তবে আমাদের দেশে কারণে-অকারণে সংক্ষুব্ধ হয়ে অথবা ঠান্ডা মাথায়, প্রতিহিংসা অথবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ এবং অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ কারণে একে অন্যকে হত্যা করছে। মানুষই মানুষের প্রতি ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু ও অমানবিক হয়ে উঠছে। এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতি এক অনিশ্চিত মানবিক সংকট হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও হানাহানির তীব্রতা যতই প্রকট হচ্ছে, অমানবিকতা ততই বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে এসব পরিস্থিতিতে মানবিক সেবা করার প্রতিবন্ধকতা। এসবই ঘটছে যুদ্ধ-হানাহানিতে মানবিক আচরণ প্রতিপালনে প্রণীত আন্তর্জাতিক মানবিক আইনসহ বিভিন্ন চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি পালনে অনীহা বা ব্যর্থতার কারণে। এ বছরের আন্তর্জাতিক মানবিক দিবসে তাই এসব আইন/চুক্তি ও অঙ্গীকার, মানবিক মূল্যবোধ এবং রেড ক্রসসহ মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ নীতিমালা প্রতিপালনে ব্যক্ত হয়েছে পুনঃঅঙ্গীকার।
একইসঙ্গে এ দিবসে মানবিক কাজে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ ও যারা মানবিক সেবায় নিয়োজিত, তাদের প্রেরণা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া যুদ্ধ বা জরুরি মুহূর্ত, এমনকি সশস্ত্র সংঘর্ষকালে নির্বিঘ্ন মানবিক সেবা পরিচালনার অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার বিষয়টিকেও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। এ দিন উপলক্ষ্যে এক বার্তায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন- সারা বিশ্বে চলমান মানবিক সংকট বিবেচনায় জাতিসংঘ ২০২৩ সালে ৩৪ কোটি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন মানুষকে মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য স্থির করেছে, যে সংখ্যাটি ২০২২ সালের চেয়ে সাড়ে ৬ কোটি বেশি ও ২০০৩ সালের চেয়ে দশ গুণ অধিক।
মানবিক সংকটের জন্য শুধুই যুদ্ধবিগ্রহ আর দ্বন্দ্ব দায়ী নয়। বিশ্বের কোথাও না কোথাও সারা বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে আছে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবিরত দাবানল, ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যা, তুরস্কে ভূমিকম্প এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে সংঘটিত সাম্প্রতিক বন্যা ও ভূমিধস ইত্যাদি পরিস্থিতিতে মানবিক দুর্ভোগ মোকাবিলায় চলছে অবিরত প্রচেষ্টা।
দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ, সশস্ত্র সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন মানবিক সংকটে ভুক্তভোগীদের ও মানবিক কর্মীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন অথবা অঙ্গীকার রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-১৯৬৫ সালে রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট গৃহীত চারটি প্রধান মূলনীতি (মানবতা, পক্ষপাতহীনতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা), রেড ক্রস, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মানবিক সহায়তা বিতরণকালে অনুসরণের জন্য ১০টি আচরণবিধি-১৯৯৪, মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গুণগত মান, সহযোগিতার আদর্শ, পরিমাণ ইত্যাদি নির্দেশনাসংবলিত ১৯৯৭ সালে সূচনা হওয়া The Sphere Humanitarian Charter (২০১৮ পরিবর্ধিত), মানবিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা এবং বৈষম্য ও পক্ষপাতহীনতা বর্জনবিষয়ক ৯টি অঙ্গীকারসংবলিত মানবিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা এবং গুণগত মূল আদর্শমান (Core Humanitarian Standard on Quality and Accountability-CHS), মানবিক কর্মকাণ্ড অধিক স্থানীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আনার উদ্যোগসংবলিত পরিবর্তনের সনদ (Charter for Change ev C4C), ‘সক্ষমতা উন্নয়ন’ নয়, ‘সক্ষমতা বিনিময়’ ও স্থানীয়করণ (Localization) উদ্বুদ্ধকরণ উদ্যোগসংবলিত প্রত্যাশার সনদ (Charter of Expectations) ইত্যাদি। এসবের সাধারণ লক্ষ্য হলো ভুক্তভোগীর সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সম্মান প্রদর্শন, সাহায্য প্রাপ্তিতে তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, তাদের সক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা এবং তাদের ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিপদাপন্নতা হ্রাসকরণ।
এক সময়ে মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিপদাপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে সাহায্য সংস্থার দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে অবজ্ঞা করা হতো, বরং ভাবা হতো-সাহায্য এক প্রকার অনুগ্রহ প্রদর্শন। তাদের ব্যক্তিগত সম্মানকেও অবজ্ঞা করা হতো। এ ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকল্পেও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ধারণা ও অঙ্গীকার রয়েছে, যেমন ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি জবাবদিহিতা, কমিউনিটিকে সম্পৃক্তকরণ ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি। আমাদের দেশেও বিপদাপন্ন বা উপকারভোগীদের প্রতি সম্মান তথা তাদের মূল্যায়নের বিষয়টিতে গুরুত্ব প্রদান ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেনে চলা হচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিভিন্ন সনদ ও অঙ্গীকার প্রতিপালন ও বিভিন্ন পক্ষের নজরদারি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
এদিকে যুদ্ধ বিষয়ে রয়েছে অনেক প্রাচীন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন; যেমন- আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (হেগ কনভেনশন ও জেনেভা কনভেনশন), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, রিফিউজি আইন ইত্যাদি। এতসব সত্ত্বেও কখনো থেমে থাকেনি মানবিকতার প্রতি অবজ্ঞা। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা (৬ আগস্ট) ও নাগাসাকিতে (৯ আগস্ট) বোমা হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে যথাক্রমে ৮০ ও ৭৪ হাজার মানুষ মারা যান। অথচ জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯) অনুসারে যুদ্ধকালে বেসামরিক মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ১৯৬টি দেশ অঙ্গীকারবদ্ধ।
১৯৬৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে ১২টি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে, যাতে বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীনসহ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র স্বাক্ষর করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এসবের প্রয়োগে সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট প্রতীয়মান। মনে পড়ে ইরাক যুদ্ধ শুরুর (২০০৩) পূর্বক্ষণে জাতিসংঘসহ সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ, তখন তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান অসহায় হয়ে বলেছিলেন-‘ইরাকের ভাগ্য এখন ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই’।
আর গত বছর জাপানের হিরোশিমায় বক্তৃতাকালে জাতিসংঘর বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন-বিশ্বব্যাপী চলমান সংকটের কারণে পারমাণবিক বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, বিশ্বমানবতা একটি ‘গুলিভরা বন্দুক’ নিয়ে খেলছে। জাতিসংঘের দুই মহাসচিবের এ অসহায়ত্ব যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কেননা দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা মানবিক সংকট উত্তরণে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে কেবলই ‘বাংলাদেশের পাশে থাকা’র কথা শোনা যায়। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পরিকল্পনায় চীন বিরোধিতা করেছে।
এ বছরের বিশ্ব মানবিক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘No Matter What’, যার মর্মার্থ হলো মানবিক কর্মী সব ক্ষেত্রেই মানুষকে সাহায্য করে, যেখানে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি কোনো ব্যাপার নয়। একজন মানবিক কর্মী বা স্বেচ্ছাসেবক কখনো নীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করে না, সেখানে যতই চাপ বা হুমকি আসুক না কেন। তাই দিবসের প্রতিপাদ্য এ বার্তা দিচ্ছে যে, এসব মানবিক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ এবং তাদের পাশে থেকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ তারা মানুষের জীবনরক্ষা ও দুর্দশা প্রশমনে কাজ করে। বস্তুত মানুষ ও বিবদমান পক্ষের মধ্যে সহিষ্ণুতা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইন-চুক্তি ও অঙ্গীকার প্রতিপালন এবং মানবিক কর্মীদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সম্ভব মানবিকতার বিকাশ।
এম এ হালিম : বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক, দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকিহ্রাস ব্যবস্থাপনা বিভাগ