প্রেমের ফাঁদে ফেলে নগ্ন ভিডিও ধারণ শাহনাজ চক্রের কয়েক কোটি টাকার ব্ল্যাকমেইলিং


সুন্দরী তরুণী। চলাফেরা করে ওয়েস্টার্ন কালচারে। দামি পোশাক পরেন। কথা বলেন সুমধুর কণ্ঠে। চালচলনে, ফ্যাশনে, কথাবার্তায় যে কাউকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। আর এসবকে পুঁজি করে তিনি চক্রের নারী সদস্যের দায়িত্ব পালন করে। সমাজের প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে। তার মোবাইল নম্বর ও ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করে। নিজে থেকেই যোগাযোগ করে। একবার কেউ কথা শুরু করলে তার প্রেমে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না।
নিজের সুমধুর কণ্ঠ দিয়ে টার্গেট যেকোনো বয়সের পুরুষকে আকৃষ্ট করে। দ্রুত তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। আপত্তিকর কথাবার্তা বলে টার্গেট ব্যক্তিকে দুর্বল করেন। সময়ে-অসময়ে ভিডিও কলে এসে নগ্ন হয়। মেসেঞ্জারে আপত্তিকর বার্তা ও ছবি পাঠায়। যখন বুঝতে পারে ওই ব্যক্তি তার প্রতি পুরোপুরি আসক্ত তখন তাকে মিলিত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। যে তার প্রস্তাবে রাজি হয় তার জীবনেই নেমে আসে একটা দুঃসময়। সুন্দরী ওই নারী একান্ত সময় কাটানোর কথা বলে নিয়ে যায় তার সুবিধামতো বাসায়। সেখানে যাওয়ার পরপরই ওই তরুণীর আসল পরিচয় বের হয়ে আসে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণী জানান দেয় সে একটি চক্রের সদস্য। কারণ ফ্ল্যাটে প্রবেশের পরেই চক্রের অন্যান্য নারী ও পুরুষ সদস্যরা হাজির হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভুক্তভোগীকে পরিচয় দেয় তারা ডিবি’র সদস্য, কেউ সাংবাদিক। তারপর ভুক্তভোগীকে বেধড়ক পেটানো হয়। হাতিয়ে নেয়া তার কাছে থাকা মূল্যবান সবকিছু। মারধর দিয়ে তাকে নগ্ন করে চক্রের নগ্ন নারী সদস্যেদের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হয়। তারপর নগ্ন ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে বেধড়ক পেটানো হয়। ভুক্তভোগী তখন মান-সম্মানের ভয়ে টাকার ব্যবস্থা করে দেয়। অনেক সময় ভুক্তভোগী তার কাছে থাকা, মোবাইল ব্যাংকিং, এটিএম ও ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা তুলে দেয়। অনেক সময় বিকাশের মাধ্যমে টাকা এনে তাদের চাহিদা পূরণ করে।
প্রেমের ফাঁদে ফেলে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে টাকা আদায়কারী এই চক্রটি গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। অনেকেই তাদের ফাঁদে পড়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের চাহিদামতো টাকা দিতে অপারগ হয়ে অনেকে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হন। এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগ আসার পর তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় ও এক ভুক্তভোগীর মামলার প্রেক্ষিতে ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (উত্তর) টানা অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলো- মো. আব্দুস সালাম (৩৮), মো. নাজমুল হাসান (৩০), মো. মাসুম শেখ (৩৫) ও শওকত আলী শেখ (৬০)। তাদেরকে ১৮ই আগস্ট ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ৫ দিনের রিমান্ডে আছে। এছাড়া ২০শে আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় মো. জহিউর রহমান ওরফে তুষার (৩৩), মো. মাসুদুর রহমান ওরফে মিলন (৪০), মনজুমা বেগম ওরফে শাহিনুর আক্তার ওরফে শাহনাজ (২৮) ও রিমা আক্তারকে (২৫)। তারা ৩ দিনের রিমান্ডে আছেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মডেলের ১০টি মোবাইল সেট, ২১টি সিম কার্ড, নগদ ৪১ হাজার টাকা, ১টি স্বর্ণের চেইন ও ১টি আংটি উদ্ধার করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মো. জহিউর রহমান ওরফে তুষার এই চক্রের মূলহোতা। চক্রের নারী সদস্যরা টার্গেট ঠিক করে তার কাছে তথ্য দেয়। মো. মাসুদুর রহমান ওরফে মিলন চক্রের সহযোগী হিসেবে ভুয়া ডিবি সদস্যর দায়িত্ব পালন করে। মনজুমা বেগম ওরফে শাহিনুর আক্তার ওরফে শাহনাজ টার্গেট ঠিক করে তাদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তার প্রতি আসক্ত করে। রিমা আক্তারও একই কাজ করে। মো. আব্দুস সালাম ভুয়া ডিবি অফিসারের অভিনয় করে। মো. নাজমুল হাসান সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী, মাসুম শেখ ভুয়া ডিবি সদস্যের পরিচয় দেয়। এছাড়া শওকত আলী শেখ ট্রাপিং এর জন্য ব্যবহার করা গাড়ি ভাড়া করে দেয়। চক্রের নারী সদস্যরা ফেসবুক ও মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে টার্গেট ব্যক্তিদের চক্রের সদস্য শওকত আলী শেখের ভাড়া করা নির্দিষ্ট বাসায় ডেকে নিয়ে যায়। পরে ওই বাসায় ভুক্তভোগীকে আটকে রেখে চক্রের নারী ও পুরুষ সদস্যরা উপস্থিত হয়। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীকে মারধর করে জোরপূর্বক নগ্ন করে চক্রের নগ্ন নারীদের পাশে দাঁড় করিয়ে নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করে। ডিবি জানায়, চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কারসহ সবকিছু তাদের কাছে নেয়। পরে বিকাশ, নগদ, রকেটসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা থাকলে সেগুলো ক্যাশ আউট করে। তারপর ভুক্তভোগীর সঙ্গে যদি ক্রেডিট ও ডেবিড কার্ড থাকে তাহলে সেগুলো দিয়ে টাকা ক্যাশ করে। ক্রেডিট কার্ডের লিমিট অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্য কিনে নেয়। এভাবে তারা গত ৪ বছরে অন্তত তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রের মূল ভুমিকা পালন করতো সুন্দরী নারী সদস্যরা। চক্রের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতো। আবার নারীরাও টার্গেট করে কথাবার্তা শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্যই থাকে যেকোনো কৌশলে টার্গেট ব্যক্তিকে দুর্বল করে তার প্রতি আসক্ত করা। আর এজন্য ওই নারী সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। বিশেষ করে আপত্তিকর ছবি, ভিডিও, কথা, ভিডিও কলে নগ্ন হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করে টার্গেট ব্যক্তিকে দুর্বল করতো। আর এই কাজ করতো চক্রের শাহনাজ ও রিমা। তারা দু’জনেই এই কাজ ভালো পারতো। প্রতারণা করে যে আয় হতো সেটি তারা কমবেশি করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিত।
এই চক্রের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে এক ভুক্তভোগী উত্তরা পূর্ব থানায় গত ১৬ই আগস্ট পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, এক বছর আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে শাহনাজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে ১৫ই আগস্ট শাহনাজ তাকে কৌশলে যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা এলাকার একটি বাসার ফ্ল্যাটে যান। তিনি ফ্ল্যাটে যাওয়ার পরপরই অজ্ঞাতনামা ২ জন নারী শাহনাজের বান্ধবী পরিচয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর আরও ৫/৬জন পুরুষ প্রবেশ করে নিজেদেরকে ডিবি পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীকে মারধর করা শুরু করে। তার পরনের কাপড় খুলে জোরপূর্বক নগ্ন অবস্থায় চক্রের নারী সদস্যদের পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। একপর্যায়ে তারা তার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তখন চক্রের সদস্যরা তার কাছে থাকা নগদ ৬ হাজার টাকা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ডেবিড ও ক্রেডিট কার্ড জোরপূর্বক হাতিয়ে নেয়। ভুক্তভোগীর কাছ থেকে পিন নিয়ে তারা এটিএম বুথ থেকে ৩ লাখ টাকা তুলে নেয়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মৌ-প্রিয়া জুয়েলার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪ লাখ ৪ হাজার টাকার কেনাকাটা করে। এভাবে তার কাছ থেকে মোট ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়। পরে মেরে ফেলা ও ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে বাদীকে ভূঁইগড় বাসস্ট্যান্ডে এনে ছেড়ে দেয়।
ডিবি সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফউল্লাহ বলেন, চক্রটি খুব নিখুঁতভাবে কাজ করতো। বিশেষ করে নারীরা এমনভাবে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতো ভুক্তভোগীদের কিছুতেই অন্যকিছু ভাবার সুযোগ থাকতো না। তার প্রলোভন ও আপত্তিকর কথাবার্তায় প্ররোচিত হয়ে অনেকেই দুর্বল হয়ে যেত। পরে একান্ত সময় কাটাতে গিয়েই ধরা খেত। এই চক্রটি অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে এভাবে ব্ল্যাকমেইলিং করেছে। তাই অল্প সময়ে পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে অপরিচিত কোনো স্থানে না যাওয়াই ভালো। আর গেলেও যাওয়ার আগে পরিবারের সদস্য বা কাছের কাউকে অবহিত করে যাওয়া। অপরিচিত কোনো নারীর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমের বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনে সতর্ক থাকা। প্রতারিত হলে তাৎক্ষণিক পুলিশের সহায়তা নেয়া এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, চক্রের ৮ সদস্য রিমান্ডে আছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।