ড. ইউনূস কি আইনের ঊর্ধ্বে?


আবদুল হাই খান
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের করা লেবার কোর্টের মামলা নিয়ে উনার পক্ষে দেশ ও বিদেশে উনার সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী গণবিবৃতি দেয়ায় এ নিয়ে আজকাল বলাবলি হচ্ছে নোবেল লরিয়েট বলে উনি কি আইনের ঊর্ধ্বে? না, নিশ্চয়ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আইনকে নিজের মত করে চলতে দিলে এ নিয়ে কারো কথা বলার সুযোগ ছিল না। মামলার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন এ মামলা উদ্দেশ্যমূলক।
১। উনাকে বিশ্বাসঘাতক, পদ্মা নদীতে চুবানোর দরকার বলা হয়েছে।
২। তার সাথে তাল মিলিয়ে অনেকে তার এবং তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভাল ভাবে না জেনে মনগড়া কথা বলে চলেছেন। লেখা-লেখি করছেন। টক-শো তে তাকে তুলো ধুনা করছেন।
৩। আমরা জানি লেবার কোর্টে অধিকাংশ মামলা হয় দেওয়ানী মামলা।
৪। ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার-এর মদতে লেবার কোর্টে ফৌজদারী মামলা দায়ের করেছে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য।
৫। তার আইনজীবি জানিয়েছেন, অভিযোগগুলো দেওয়ানী হলেও সরকার-এর মদতে জোর করে ফৌজদারী ধারা সংযোজন করেছেন।
৬।
তার আইনজীবি জানিয়েছেন, একজন লেবার ইনসপেক্টর ২০২১ সালে গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শন করে কতিপয় অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। অথচ গত দুই বছর এ মামলা অগ্রসর হয় নাই। হঠাৎ যখন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বললেন উনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালত ও দুদক দেখবে তারপর থেকে তড়িঘড়ি করে মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। এ থেকে যে কেউ মনে করবে এটি পরিকল্পিত, শুধুমাত্র তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য।
৭। আমরা জানি, দেওয়ানী মামলা বছরের পর বছর চলে অথচ উনার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা চলছে।
৮। একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষোদগার করা হলে তার ন্যায় বিচার পাওয়ার কি সুযোগ থাকে?
এবার আসি কিছু লোক ও সাংবাদিক ভাইদের নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে।
ড. ইউনূস দেশের জন্য কিছু করেন নি?
গ্রামীণ ব্যাংকের মত বিশাল প্রতিষ্ঠান কি বিদেশীদের আর্থিক ও অন্যান্য সেবা দিয়ে আসছে? ৯৮ লক্ষ পরিবার এ ব্যাংকের সাথে যুক্ত। যে কেউ গবেষণা করে দেখতে পারেন এ সেবায় সদস্যদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিনা। ড. ইউনূসের এ ধারণাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে হাজার এনজিও দরিদ্র মানুষদের নানামুখী সেবা দিয়ে আসছে। ক্ষুদ্রঋণ রেগুলেটরী অথরিটি এগুলো দেখভাল করছে।
বাংলাদেশে টেলিনরকে নিয়ে এসে গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠা করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে মোবাইল বিপ্লব সাধন করেছেন। আজ বাংলাদেশে সবার হাতে যে মোবাইল তার অবদান ড. ইউনূসের । কই উনি তো গ্রামীণ ফোনের একটা শেয়ারও নেন নাই? গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোনের লভ্যাংশ দিয়ে হাসপাতাল নির্মাণ, গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে নিবিড় পল্লী এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানসহ আরও বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা যেমন-গ্রামীণ ডানোন, দাউদকান্দির পল্লী এলাকায় মেঘনার পানি কে বিশুদ্ধ করে সরবরাহ করা কি দেশের জন্য করা না?
গ্রামীণ শিক্ষার মাধ্যমে অবহেলিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বৃত্তি দেয়া কি দেশের জন্য কাজ নয়? উনি সুদখোর, ৩০% সুদ নেয়। গ্রামীণ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট দেখলেই তা জানতে পারেন কোন ঋণের সুদের হার কত? বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছর অডিট করে কখনও বলেনি সুদের হার বেশি। গ্রামীণ ব্যাংক শতকরা ২০% ক্রমহ্রাসমান হারে সুদ নেয় যা ফ্লাট রেটে ১০% এমআর এ খোঁজ নিয়ে দেখুন অন্যান্য এনজিও কি তার থেকে কম সুদ নেয়? গ্রামীণ ব্যাংক এক অভিনব সামাজিক ব্যবসা যার ২৫% শেয়ারের মালিক সরকার ও ৭৫% শেয়ারের মালিক ঋণ গ্রহীতা সদস্যরা যারা শেয়ার কিনেছেন। উনার ব্যবসা এ ব্যক্তিগত মুনাফার ইচ্ছা থাকলে ৭৫% শেয়ার সদস্যদের না দিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারতেন অথবা পুরোপুরি বেসরকারী ব্যাংক করতে পারতেন, কই তিনি তো তা করেননি? কাজেই সুদের ভাগ নিয়ে থাকলে সরকার নেয় ২৫% ও যারা সুদ দেন সেই সদস্যরাই নেন লভ্যাংশের ৭৫%। কাজেই ড. ইউনূস কিভাবে সুদখোর ও রক্তচোষা হলেন, বুঝতে পারছি না। আসলে যে সকল বন্ধুরা জেনে ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মনগড়া কথা বলেন তাদের কারো কাছে প্রকৃত তথ্য নির্ভর কোন সদুত্তর নেই, থাকার সুযোগও নেই। কোন বন্ধুকে টার্গেট করে বিচার করা হলে তার বন্ধু-বান্ধব, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীগণ বিবৃতি দিলে কেন তা বিচার বিভাগের প্রতি হস্তক্ষেপ হবে। তাহলে মানুষ যদি বলে বিভিন্ন মিডিয়ার টক-শো তে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একতরফা কথা বলে যে মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে সেটাতো বিচার বিভাগের প্রতি হস্তক্ষেপের চেয়েও বেশি। দেশের জনগণকে বোকা ভাববার কোন কারণ নেই। মানুষ একদিন সত্য জানবেই, সত্য বের হবেই।
উল্লেখ্য যে, আমরা আশে পাশে তাকালে দেখি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানীতে প্রতিষ্ঠাতা তার ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের বড় পদে আসীন করেন। কই ড. ইউনূসের কোন প্রতিষ্ঠানে তিনি তো তা করেননি। মহৎ মনের মানুষ বলেই তিনি তা করেননি। আমরা জানি, আমাদের পরিবারের সবাইকে আমরা সন্তুষ্ট করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে হাজার হাজার কর্মচারীর মধ্যে কেউ কেউ অসন্তষ্ট হয়ে মামলা করতেই পারেন। কিন্তু উসকানী দিয়ে মামলা করানো নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে।
আরও দুটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই:
প্রচার করা হচ্ছে ড. ইউনূস ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন? উনি উনার সমস্ত টাকা-পয়সা ইউনূস ট্রাস্ট-এ দান করে দিয়েছেন। দেশে বিদেশে বাড়ী, জমি, ব্যবসা বা কোন কোম্পানীর শেয়ার, কোনো কিছুতে তার কোন মালিকানা নেই। তার আইনজীবি বলেছেন, দান করা অর্থের জন্য কোন দান কর দিতে হবে না। রাজস্ব বোর্ড দাবি করেছে যে, দানকর দিতে হবে। বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য প্রফেসর ইউনূস আদালতে যান। অবশেষে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে দানকর দিতে হবে। তখন তিনি দানকর পরিশোধ করে দেন।
রাজস্ব বোর্ড এ ব্যাপারে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে কোন মামলা করেনি। করেছেন প্রফেসর ইউনূস। কিন্তু প্রচার মাধ্যম বলে চলেছে প্রফেসর ইউনূস কর ফাঁকি দিয়েছেন এবং রাজস্ব বোর্ড তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিষয়টি একেবারে গুলিয়ে ফেলে প্রফেসর ইউনূসকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এখানে ট্যাক্স “ফাঁকির” বিষয় নেই। এখানে সরকারের চাপ থেকে মামলা করার বিষয়ও নেই। মনের মাধুরী দিয়ে অনেক মনগড়া কথা বলা যায়। উনি বহুবার বলেছেন, উনি সম্পদবিহীন থাকতে চান এবং এ কারণে সব অর্থ ট্রাস্ট এ দান করে দিয়েছেন, তারপরও বলা হচ্ছে উনি হাজার হাজার টাকা বিদেশে পাচার করে ব্যাবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন।
কোন দেশে কোন ব্যাবসা উনি গড়ে তুলেছেন তা পরিষ্কার করলে দেশবাসী সত্যি জানতে পারত। যিনি তার সব অর্থ ট্রাস্ট এ দান করে দিয়েছেন, তিনি কেন শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎ করবেন? খোঁজ নিয়ে দেখেন গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ ডব্লিউপিপিএফ-এর টাকার কেউ কেউ কয়েক কোটি টাকা পেয়েছেন। পরিশেষে বলতে চাই, যত কলংকই ড. ইউনূসের গায়ে লাগানো হোক না, জোর করে ক্ষমতার দাপটে জেল-জরিমানা যাই করা হোক না ড. ইউনূস, নোবেল ড. ইউনূস-ই থাকবেন।
মনে রাখতে হবে, গ্লোবাল আইকন বাঙালি ড. ইউনূস বাংলাদেশকে যে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেছেন, যে মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছেন তা দেশবাসী (কতিপয় দলকানা লোক ছাড়া) সবার অন্তরে তিনি থাকবেন। যুগে যুগে ড. ইউনূসরা জন্ম নিবে না। ভবিষ্যতে জাতির কপালে হয়ত আরো নোবেল জুটত সেই গুড়ে, আমরা বালি দিয়ে দিলাম। সবশেষে বলা যায়, সরকার প্রধান যখন প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে ড. ইউনূস-কে কুশ্রী ভাষায় আক্রমণ করে তথ্য প্রমাণ ছাড়া দোষী সাব্যস্ত করেন তখন বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় কোন বিচারক আছেন যিনি ন্যায়ানুগ রায় দিবেন? এ জাতীয় বক্তব্য কি বিচার কাজে হস্তক্ষেপ নয়?
লেখক: উন্নয়ন কর্মী