রাজনীতি

ছাত্রলীগে সাঈদীপ্রেমী : শুরু হবে শুদ্ধি অভিযান

student lig 20200310175310
print news

‘কমিটি-বাণিজ্য’ ঘোরতর এ অভিযোগ গত দুই যুগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যারাই হয়েছেন তাদের সঙ্গেই জড়িয়ে থেকেছে। কিছু অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে, কিছুর মেলেনি। তবে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটার প্রমাণ ভূরি ভূরি। এ সত্য চিরন্তন সত্যের রূপ পেয়েছে গত ১৪ আগস্ট জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যে পরিমাণ নেতা শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, তাতে ছাত্রলীগে ‘আগাছা’ ঢুকেছে এবং ছাত্রলীগে কমিটি-বাণিজ্য বর্তমান এ সত্যকেই প্রমাণ করেছে এবং করছে।

শুধু কমিটি-বাণিজ্যই ছাত্রলীগের এ অধঃপতনের মূল কারণ নয়। সংগঠনের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালনকারী নেতারা বলেন, আদেশ-নির্দেশ, অনুরোধ ও আর্থিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে নেতা বানানোর পথ সৃষ্টি করেই ছাত্রলীগে আগাছা-পরগাছার প্রবেশ ঘটছে। তারা বলেন, নেতা হওয়ার পূর্বশর্ত মাঠের অ্যাকটিভিটিজ। নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে এখন সেটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছাত্রলীগে ভর করার সুযোগ পেয়েছে। আগাছার চাষই হয়েছে গত দুই যুগে।

সাবেক নেতারা বলেন, গত দুই যুগে অনুরোধ ও আর্থিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে নেতা বানানোর চর্চা হয়েছে বেশি। আর নেতা হয়েই সুযোগে তারা জানান দিচ্ছে, ‘আমরা ছাত্রলীগ নই’। এ প্রসঙ্গে খেদোক্তি করেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মনসুর ও সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।

গত ২০ আগস্ট সাঈদী-অনুসারী ১৫ নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ। জেলা সভাপতি দীপঙ্কর কান্তি দে ও সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান রিপন স্বাক্ষরিত ওই অব্যাহতিপত্রে ১৫ জনকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া জামালপুরে ১৮, চট্টগ্রামে ১৬, পাবনায় ৭, নরসিংদীতে ৬, সাতক্ষীরায় ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লোহাগড়ায় ৯, ফরিদপুরে ৯ জনকে এবং  সোমবার কুমিল্লায় ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ইতিমধ্যে এ সংগঠনের চার শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার অব্যাহত রয়েছে। আগাছা-পরগাছামুক্ত করে সুশৃঙ্খল সংগঠনে পরিণত করার জন্য একাধিকবার তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তারপরও থেমে নেই নীতি-আদর্শে অবিশ্বাসী ছাত্রনেতাদের ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ। সাঈদীর মৃত্যুতে মুখোশের আড়াল থেকে আগাছাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।

সাঈদীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু করে একটি বিশেষ মহল। তাদের আদ্যোপান্ত খুঁজে দেখা যায় শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির ধারায় বিশ্বাস করে যে সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছে যে সংগঠন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সংগঠনের কর্মীরা পরিচালিত হয়েছে সে সংগঠনের কর্মীরাই কিনা যুদ্ধাপরাধের, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দণ্ডিত সাঈদীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে! এদের পরিচয়ের মূলে তাহলে কী?

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান  বলেন, ‘আগাছার ছাত্রলীগে ভর করার ঘটনা দুঃখজনক। বিভিন্ন সময় ওদের হাতে সুযোগ এসেছে, ওরা ঢুকে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘স্রোতের সঙ্গে রুই-কাতলা, বোয়াল ও পুঁটি মাছ ঢুকে পড়ে। ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এসব আগাছা নেতাদের তালিকা করার এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার এ প্রসঙ্গে  বলেন, ‘এ ঘটনাকে শুধু অনুপ্রবেশের ঘটনা হিসেবে দেখলে সংশ্লিষ্টরা দায় চাপানোর এবং খালাস পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তাতে ঠিক শিক্ষা নেওয়া হয় না। এতে খণ্ডচিত্র প্রকাশিত হয়। সাঈদীর মৃত্যুর পর যে চিত্র পাওয়া গেছে, এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে যা দেখা গেছে তা দুঃখজনক।’

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘পুরো ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখলে হবে না। আমি বলতে চাই, সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংগঠনে ঢুকেছে অতি সাধারণভাবে, আকৃষ্ট হয়ে বা পছন্দ করে। আজকের চিত্র দেখে আমি বলতে চাই, নীতি-আদর্শের চাষবাস না হওয়া একটা নেতিবাচক আবহ তৈরি করেছে ছাত্রলীগে। যারা ঢুকে পড়েছে তাদের ভেতরে নীতি-আদর্শের প্র্যাকটিস করানো হলে ফল অন্যরকমও হতে পারত।’

ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের দাবি, টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতার প্রভাব, জানান দেওয়ার মানসিকতা, ক্ষমতা ধরে রাখার মহাযুদ্ধ। তৃণমূলে এ যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি। ফলে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেন সবাই। ‘নিজের লোক’কে পদ পাইয়ে দিতে আর কিছু দেখা হয় না। তারা দেখে ‘ভাইলীগ’ কতটা শক্তিশালী হলো।

প্রয়োজনে সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করতে ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সহানুভূতি প্রকাশ করে কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না। সব সাংগঠনিক ইউনিটকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ ধরনের সবাইকে বহিষ্কার করতে বলা হয়েছে।

ছাত্রলীগে এত আগাছা কেন এমন প্রশ্নে সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন  বলেন, ‘পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা করে সুযোগ নেওয়ার কারণে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তবে আমরা সমন্বিত উদ্যোগে শক্ত বাঁধ তৈরি করছি। আমরা অভিযান শুরু করেছি। ওদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। পবিত্র ধর্মকে হাতিয়ার করা এ দেশে বেশ পুরনো। রাজনৈতিক চেতনার ওপর ধর্মচেতনা এ কথাই এরা ছাত্রদের মাথায় ঢুকিয়েছে। ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে। এ ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি।’

ছাত্রলীগের শীর্ষ এ নেতা বলেন, ‘ফেইসবুক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই হচ্ছে। সরকারি দল হওয়ায় অনুপ্রবেশকারী থাকেই। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ছাত্রলীগ তার নৈতিক শুদ্ধতা প্রমাণ করেছে।’

সাদ্দাম আরও বলেন, ‘অতীতে সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী ও মুখোশ পরা কাউকে চিহ্নিত করা হয়নি। এখন আমরা চিহ্নিত করছি, ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *