রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন


।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।
হযরত আয়েশা (রাযি.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাধিক মুহসিন সাহায্যকারী ও একনিষ্ঠ ভক্ত, জান্নাতের সংবাদপ্রাপ্ত ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাযি.)এর অতি আদরী কন্যা। তাঁর মাতার নাম ছিল হযরত যয়নাব (রাযি.)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের চতুর্থ বছর তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
হযরত আয়েশা (রাযি.) ছোট বেলা থেকেই ছিলেন শান্তশ্লিষ্ট তীক্ষ্ণ ধী-শক্তির অধীকারিনী। হযরত আবুবকর (রাযি.)এর ইচ্ছা ছিল তাঁর এ মেয়েকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিয়ে দিতে। কিন্তু লজ্জায় তিনি বলতে পারছিলেন না। আল্লাহ তাআলা আবু বকর (রাযি.)এর আশা পুরণ করেন। বিয়ের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও স্ত্রী হিসেবে হযরত আয়েশা (রাযি.)কে দেখতে পান। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, জিব্রাইল (আ.) রুমালে পেঁচিয়ে কি যেন নিয়ে এসেছেন এবং তা তাঁর কাছে দিয়ে বললেন, এই নিন আপনার স্ত্রী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুমাল খুলে ছোট্ট শিশু হযরত আয়েশা (রাযি.)কে দেখতে পান। এরপর জাগ্রত হয়ে বলেন, এই স্বপ্ন আল্লাহর তরফ থেকে হলে সত্য হবে। এরপর বিয়ের নির্দেশ পান। তাঁর এ বিয়েতে দেন-মুহর ছিল ৫০০ দিরহাম। হিজরী ১ম সালে শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর (রাযি.)এর কাছ থেকে ৫০০ দিরহাম কর্জে হাসানা নিয়ে আয়েশা (রাযি.)এর দেন-মুহর পরিশোধ করে তাঁকে ঘরে আনেন। “হে নবী! আমি আপনার জন্য হালাল করেছি স্ত্রীদের, যাদের আপনি দেন-মুহর আদায় করেছেন”। (সূরা আহযাব- ৫০)।
পিত্রালয় হতে বিদায় নিয়ে হযরত আয়েশা (রাযি.) যে সংসারে প্রবেশ করলেন, সে সংসার মোটেই সচ্ছল ছিল না। তিনি ছিলেন ধনীর গৃহের আদরের দুলালী। সংসারের অভাব অভিযোগ ও দুঃখ-কষ্টের সাথে অপরিচিতা, অল্প বয়স্কা হযরত আয়েশা (রাযি.) আল্লাহর উপর নির্ভর করে অসীম সাহসে বুক বেঁধে সংসারে অবতীর্ণ হন। স্বামীর সংসারে এসে তিনি প্রথমে যে ঘরে প্রবেশ করেন তা ছিল মসজিদে নববীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত খেজুরের পাতার ছাউনি ও মাটির দেয়াল বিশিষ্ট একটা হুজরা মাত্র। এই ঘরটি এত নিচু ছিল যে, তার মেঝেতে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চালা স্পষ্ট করা যেত। আর ঘরের আসবাবপত্রর মধ্যে একটা খাট, একটা বিছানা, একটা ছাটাই, একটা বালিশ, দুটো মুটকা, একটা পানির কলস, দুটো বাসন, দুটো পেয়ালা ও একটা গ্লাস উল্লেখযোগ্য।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.)এর জন্য ব্যক্তিগত দাসীনির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তবুও সংসারের যাবতীয় কাজ একাই করতেন। গম ভাঙ্গানো, রুটি প্রস্তুত করাসহ যাবতীয় রান্না-বান্না থেকে শুরু করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাকাপড় স্বহস্ত্রে পরিস্কার করা, বিছানাপত্র রোদ্রে দেয়া ও বিছিয়ে দেয়া। তাঁর ওযু গোসলের পানি দেওয়া ও মাথায় তৈল মালিশ করা, মাথা আচড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি কাজগুলো তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে করতেন।
রাত্রে ঘুমানোর পূর্বে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ওযুর পানি ও মেসওয়াক শিয়রে রেখে দিতেন। অবশ্যই হযরত আয়েশা (রাযি.) নিজেই বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের সংসারে কাজ-কর্মে বিশেষ কোন ঝামেলা ছিল না। কারণ, নানা প্রকারের উপাদেয় খাদ্য পাক করে উদর ভর্তি করার মত উপকরণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহে ছিল না। কোন কোন সময় একাধিক্রমে মাসাধিক কাল পর্যন্ত উনুনে আগুন জ্বালানোর প্রয়োজন হত না। শুধু খেজুর ও পানির উপরেই দিন কেটে যেত। নবী পরিবারে কেউ কোনদিন একাধিক্রমে তিন বেলা উদর পুর্তি করে আহার করার সুযোগ পেতেন না। প্রতিদিন সবার আহারের পরে হযরত আয়েশা (রাযি.) নিজে আহার করতেন। এতে অধিকাংশ সময় তাঁকে সর্বাপেক্ষা কম আহার করতে হত, কখনো বা সম্পূর্ণ অনাহারে থাকতে হত। অথচ সে জন্য তিনি কিছু মাত্র দুঃখিত হতেন না। বরং নিজের জন্য অবশিষ্ট খানা গরীব দুঃখীকে বিলিয়ে দিয়ে নিজে অনাহারে থাকতেন এবং আনন্দ অনুভব করতেন। একেই বলে আল্লাহর প্রেমিক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সব বিবিদের জন্য বার্ষিক চারশত মণ খেজুর এবং একশত মন যব নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। এ খাদ্য হতেই তাঁরা ইচ্ছেমতো দান-খায়রাত ও মেহমানদারী করতেন। ফলে বছরের শেষে সকলেরই খাদ্যাভাবে অর্ধাহারে বা অনাহারে কাটাতে হত। আয়েশা (রাযি.)এর মেহমান বেশী এবং দানের পরিমানও বেশী হওয়ায় তাঁরই বেশী খাদ্যাভাব হত। এরূপ অভাবের সংসারেও তিনি কোন দিন স্বামীর নিকট বা পিতার নিকট কোন জিনিসের জন্য আবদার জানাতেন না বা কোন প্রকার অভিযোগ করতেন না। বরং সারাদিন অনাহারে থাকলেও পারতপক্ষে তিনি কাউকে জানতে দিতেন না। আর সংসারে এত পরিশ্রমের ভিতরেও তিনি কখনও নানায রোযার প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা প্রদর্শন করতেন না। বছরের অর্ধেকের বেশী সময় ধরে তিনি নফল রোযা রাখতেন।
ইসলামের খেদমতে যাঁরা স্বীয় জীবন উৎসর্গ করে ইসলামের ইতিহাসে চির-স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, হযরত আয়েশা (রাযি.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবিদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রাযি.)কেই সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসতেন তাঁর বিভিন্ন গুণের জন্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূপের চেয়ে গুণেরই অধিক সমাদর করতেন। তাই আয়েশা (রাযি.)এর দাম্পত্য-প্রেম অত্যন্ত মধুর ও গভীর হয়েছিল। অবশ্য তিনিও অতুলনীয় রূপবতী ছিলেন।
এক সময়ে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি কাকে সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসেন? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, পুরুষদের মধ্যে আবুবকর এবং স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশার মত প্রিয় আমার আর কেউ নেই। হযরত আয়েশাকে বেশী ভালবাসার জন্য অন্য বিবিদের মনে স্বাভাবিকই ঈর্ষার উর্দ্রেক হত। একদিন তাঁরা সকলে মিলে হযরত ফাতেমা (রাযি.)এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটা অনুযোগ পাঠালেন। ফাতেমা (রাযি.) পিতার কাছে গিয়ে কথাটি উত্থাপন করলে তিনি ফাতেমাকে বললেন, মা! আমি যা ভালবাসি, তুমি কি তা ভালবাস না? প্রতি উত্তরে ফাতেমা (রাযি.) পিতার এই একটি মাত্র কথায় তাঁর মনোভাব বুঝতে পারলেন এবং আর কোন কথা না বলে চলে আসলেন।