ফিচার

নার্সারি গ্রাম : ফুলই অলংকারকাঠি গ্রামের অলংকার

image 61668 1550033971
print news

পিরোজপুর সংবাদদাতা: সারাদেশের গাছের চারার চাহিদার একটা বড় অংশের যোগান আসে পিরোজপুরের নার্সারিগুলো থেকে। এই জেলায় রয়েছে রকমারি ফুল ও ফলের গাছের চারা ও কলম। পাশাপাশি রয়েছে বনজ ও ঔষধি গাছের চারাও। যা সরবরাহ করা হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

পিরোজপুরে নার্সারি শুরুর ইতিহাস প্রায় দু’শ বছর পুরনো। জেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২ হাজার ১৭০টি নার্সারি রয়েছে। যেখানে পাওয়া যায়, ফল, ফুল, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা ও কলম। রয়েছে দেশী ও বিদেশী দুই ধরণের গাছই।দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতারা আসেন এখানে, নানা জাতের চারা কিনতে। বর্ষা মৌসুমে বিক্রি হয় সবচাইতে বেশি। এবারে বিক্রির মধ্য দিয়ে করোনাকালের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আশা করছেন নার্সারি সংশ্লিষ্টরা।স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা জানালেন, দেশে চারা ও কলমের চাহিদার ৪০ শতাংশই পূরণ করে পিরোজপুরের নার্সারিগুলো। এব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে থাকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।জেলার নার্সারিগুলোতে প্রতি মৌসুমে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করে থাকেন।দেশের চারার চাহিদার ৪০ শতাংশই পূরণ করে পিরোজপুরের নার্সারিগুলো। এখানে যেমন রয়েছে চোখ জুড়ানো রকমারি ফুল গাছ, তেমনি আছে নানা রকমের হাজারো ফলের চারা। পাশাপাশি রয়েছে তুলনামূলক সস্তা দামের বনজ বৃক্ষ।

নার্সারি বিপ্লবে বদলে গেছে পিরোজপুরের নেছারাবাদ গ্রামের জীবনধারা। এখানকার প্রায় সব মানুষই নার্সারি করে বারো মাস ফল-ফুল উৎপাদন করছেন। এ থেকে তারা স্বাবলম্বীই শুধু নন, সচ্ছলও হয়ে উঠেছেন। ফলে পুরো গ্রামে এখন আর কেউ বেকার নেই। নেই কোনো ভিক্ষুকও। বরিশাল থেকে সড়কপথে বানারীপাড়া হয়ে নেছারাবাদ যাওয়ার পথে চোখে পড়ে একের পর এক নার্সারি। এ সড়কের অলঙ্কারকাঠি নার্সারির প্রাণকেন্দ্র। ভারত ও বগুড়ার বীজে চলছে এ নার্সারি গ্রাম। জানা গেছে, আগে নেছারাবাদের মানুষ শখের বশে গাছের চারা উৎপাদন করলেও কয়েক দশকে তারা নার্সারির বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ৩৮ গ্রামে ৪৮৫ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে ফলদ, বনজ ও ফুল গাছের প্রায় ২ হাজার নার্সারি। এতে ভাগ্য ফিরেছে এলাকার মানুষের। এ সাফল্য দেখে নার্সারি ছড়িয়ে পড়েছে পাশের বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলায়ও। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি নার্সারি মালিক নিজে এবং সহায়ক শ্রমিক লাগিয়ে কাজ করছেন। এভাবে কাজ করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। মালিকের পাশাপাশি শ্রমিকরাও কর্মসংস্থান পেয়েছেন। নার্সারির কয়েকজন শ্রমিক জানান, অন্য কাজের চেয়ে নার্সারির কাজে কষ্ট কম। তা ছাড়া সারা বছর কাজও থাকে। বেকার বসে থাকার ভয় নেই। এসব কারণেই নার্সারির কাজে স্বচ্ছন্দবোধ করেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ শ্রমিক। এমনকি ছাত্ররাও তাদের অবসর সময়ে কাজ করছেন নার্সারিতে। শ্রমিকদের কেউ কেউ জানান, নার্সারির কাজে তেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। অভিজ্ঞদের কাজ দেখেই কৌশল রপ্ত করা যায়। সরেজমিন দেখা যায়, নেছারাবাদ উপজেলার প্রতিটি বাড়িই যেন এক-একটি নার্সারি। কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন এনজিও এবং দু-একটি বিশেষায়িত ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কেউ নিজের এক টুকরো জমিতে, কেউ আবার অন্যের জমি বর্গা নিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের নার্সারি। ফলে এই গ্রামে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যার নার্সারি নেই বা নার্সারি করে বিফল হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সবাই শোনান তাদের শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। তবে এ জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু এ গ্রামে বেকার না থাকায় অন্য কাজে শ্রমিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধান, গম, ডালসহ অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশি হওয়ায় নার্সারিতে ঝুঁকেছেন এ এলাকার মানুষ। তা ছাড়া আবহাওয়াগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বছরের বারো মাসই ফল, ফুল ও বনজ গাছের চারা উৎপাদন করে ভালো লাভ করা যায়। স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, লাভ বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলে নার্সারিশিল্পে বিপ্লব ঘটেছে। নার্সারি মালিক আবদুস ছালাম হাওলাদার এবং সাজ্জাদুল্লাহ জানান, সরকার ধানসহ অন্যান্য কৃষি ফসলে ভর্তুকি ও বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়। কিন্তু নার্সারিতে কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। সরকার সুদৃষ্টি দিলে নার্সারি আরও এগিয়ে যাবে। বরিশাল কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, নার্সারি মালিকদের সরকারি সহায়তার আওতায় আনা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে নার্সারি থেকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত তৈরি হতে পারে।

ফুলই অলংকারকাঠি গ্রামের অলংকার :

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার অলংকারকাঠি গ্রামের নার্সারিগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল ও ফুলের চারা চাষ হচ্ছে। আর এই চাষের প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করছেন।

সরেজমিনে অলংকারকাঠি এলাকার ফুলের নার্সারিগুলো ঘুরে মনে হয় সারি সারি হলুদ, লাল, কমলা ও সাদা রঙের দৃষ্টিনন্দন কার্পেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে মাঠের পর মাঠ। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। এই ফুল ক্ষেতের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে স্বরূপকাঠি-বরিশাল-ঢাকা সড়ক। ফুলের এই বাগান দেখতে দর্শনার্থীরা প্রতিটি নার্সারিতে প্রচণ্ড ভিড় করে। যা সামাল দিতে মালিকদের হিমসিম খেতে হয়।

বাধ্য হয়ে নার্সারি মালিকরা লিখে রেখেছেন এই এলাকায় প্রবেশ, ছবি তোলা ও ফুল ছেড়া নিষেধ। এরপরেও অসচেতন দর্শনার্থীরা প্রতিদিন ফুল ও চারা নষ্ট করে ফেলে।

পরশমনি নামের এক দর্শনার্থী জানান, সুযোগ পেলেই তিনি ওই এলাকায় ছুটে আসেন। এখানকার মনোরম দৃশ্য দেখে মন আর বাড়ি ফিরে যেতে চায়না।

এই এলাকার সমাজসেবক মহিবুল্লাহ বলেন, সঠিক পরিচর্যা করা গেলে এই এলাকাটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।শুধু অলংকারকাঠি গ্রাম নয় উপজেলার আকলম, সুলতানপুর, সঙ্গীতকাঠি, পানাউল্লাপুর ও আরামকাঠিসহ ১০-১২টি গ্রামে ফুলের চাষ হচ্ছে।অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফুল চাষের মৌসুম। প্রায় ৬০ বছর ধরে স্বরপকাঠিতে বনজ, ফলদ ও ওষধি চারার কলম উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে কেনাবেচা চলে আসছে। একটা সময় ফুল ও ফুলের চারার চাষ শুরু করেন চাষিরা। প্রথম দিকে সল্প পরিসরে ফুলের চাষ করেন নার্সারি মালিকরা। দিন দিন ফুলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ৭-৮ বছর ধরে এখানে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়েছে।স্বরূপকাঠি উপজেলায় প্রায় দুই শতাধিক নার্সারিতে ফুল ও ফুলের চারার চাষাবাদ হচ্ছে। এসব নার্সারিতে ডালিয়া, কসমস, সালবিয়া, স্টার, জিনিয়া, সূর্যমুখী, ক্যাপসিক্যাপ, ক্যাবিস্ট, গ্যাজোনিয়া, ক্যারোনডোনা, স্যালোসিয়া, রজনীগন্ধা, গ্যালোডিয়া, নয়নতারা, চন্দ্রমল্লিকা, ইনকাগাঁদা, স্নুবল, গোলাপসহ নানান প্রজাতির ফুলের চাষ হচ্ছে।ফুল চাষ করে এসব গ্রামের অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। ফুল ও ফুল চারা চাষাবাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় তিন হাজার শ্রমজীবী মানুষ জড়িত।পাইকাররা ও খুচরা বিক্রেতারা প্রতিদিন এখান থেকে নানা জাতের ফুল, চারা ক্রয় করে পিকআপভ্যান, ট্রলার ও নৌকায় করে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করেন।জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত আদর্শ নার্সারির মালিক মো. আব্দুস সালাম হাওলাদার  বলেন, এখানকার নার্সারিগুলো থেকে প্রতি মাসে গড়ে আনুমানিক ৪-৫ লাখ টাকার ফুল ও ফুলের চারা বিক্রি হয়। চলতি মৌসুমে ২-৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছে নার্সারি মালিকরা।

ছারছীনা নার্সারির মালিক মো. জাহিদ হোসেন পলাশ  জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতাদের পাশাপাশি খুচরা ক্রেতারাও ফুল ও চারা নিতে আসেন। বর্তমানে তার নার্সারিতে প্রায় ২৫-৩০ প্রজাতির ফুলের চারার চাষ হয়। এর মধ্যে গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ও গোলাপ ফুলের চাহিদা বেশি।

বৈশাখী নার্সারির মালিক মো. শাহাদত হোসেন  জানান, যশোর ও বগুড়া থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বীজ ও চারা আমদানি করা হয়। তবে এ ব্যবসার পুঁজির জন্য বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে লোন নিতে হয়।তিনি ফুলের চাষাবাদকে আরও প্রসারিত করার জন্য সরকারি সহযোগিতাসহ সুদমুক্ত ব্যাংক লোন দেওয়ার দাবি জানান।এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা  বলেন, এখানকার ফুল চাষিদের আর্থিক কোনও সহায়তা প্রদান না করা হলেও প্রযুক্তিগত কিছু পরামর্শ দেয়া হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *