ফিচার

অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন :কী আছে ভাগ্যে

75365 f4
print news

সারা দিন থেমে থেমে হলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয় রাজধানীজুড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় রাজপথ তলিয়ে যায় পানিতে। ওই পানির মধ্য দিয়ে মিরপুর ২ নম্বর এলাকার ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মিজান হাওলাদার। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী মুক্তা (২৫), সাত মাসের ছেলে হোসাইন ও শ্যালিকা লিমা (৭)। হঠাৎ তারা বিদ্যুতায়িত হয়ে রাস্তার পানির মধ্যে পড়ে মারা যান। এ সময় মা মুক্তার কোল থেকে ছিটকে দূরে রাস্তার পানির মধ্যে গিয়ে পড়ে শিশু হোসাইন। তাদের বাঁচাতে গিয়ে অনিক নামে এক অটোরিকশাচালকও প্রাণ হারান। তবে বাবা-মা সহ ঘটনাস্থলে ৪জন মারা গেলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন। রাতেই স্থানীয়রা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। শঙ্কামুক্ত হওয়ায় শুক্রবার সকালে তাকে রিলিজ দেয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মিরপুর ঝিলপাড় বস্তিজুড়ে অনেক আগে থেকেই বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে।

বৃহস্পতিবার রাতের ওই মর্মান্তিক ঘটনাটি এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ঘটেছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে অনেক অবৈধ সংযোগ বস্তিতে গেছে। ওইদিন রাতেও বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে একটি অবৈধ সংযোগের লাইন রাস্তায় পড়ে যায়। রাস্তায় যখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তখন আর ওই তারটি দেখা যায়নি। সেই ছিঁড়ে পড়া লাইনেই বিদ্যুতায়িত হয়ে ঝরে যায় চারটি তাজা প্রাণ।

নিহত মিজানের শ্বশুর ও স্ত্রী মুক্তার বাবা মো. মহফিজ বলেন, মিজানের বাড়ি ঝালকাঠিতে। মিরপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন। কিছুদিন আগে মিজান স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবারই তারা ঢাকায় ফিরেন। রাতে হাজীপাড়া তার (শ্বশুর) বাসা থেকে খাবার খেয়ে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা করেন মিজান দম্পতি। রাত ১০টা বাজে কমার্স কলেজসংলগ ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তার ফুটপাথের পানির মধ্য দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলেন তারা। ঘটনাস্থলে ওই দোকানের পাশ দিয়ে বৈদ্যুতের খুঁটি থেকে বের হওয়া একটা ছেড়া তার পানির মধ্যে পড়ে ছিল। আর তাতেই বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে যায় তারা। এসব দেখে শিশুটিকে প্রথমে পানি থেকে তুলে স্থানীয় এক মহিলার কাছে দেন অটোরিকশাচালক অনিক। এরপর তিনি লিমাকে উদ্ধার করতে যান। তখন অনিক, লিমা, মিজান, মুক্তা ৪জনই বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। কয়েকজন পানির পাইপ ও বাঁশ দিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করলেও তা কাজে আসেনি। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ে ও জামাই নাতিকে নিয়ে ওই যে আমার বাসা থেকে খেয়ে বের হলো- ওই বের হওয়াই শেষ। আগে জানলে তাদের কোনোদিনও ছাড়তাম না। তিনি বলেন, এই মৃত্যু মানতে পারছি না। আমার নাতিটার এখন কী হবে? মাত্র ৭ মাস বয়সে সে মা-বাবাকে হারিয়েছে।

এদিকে শুক্রবার সকালে শিশু হোসাইনকে নিয়ে মিরপুর মডেল থানায় আসেন আমেনা বেগম নামে এক নারী। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, হোসাইনের মা যখন পানিতে পড়ে যায় তখন হোসাইন মায়ের কোল থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। আমরা রাস্তার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কান্নাকাটি ছাড়া কিছুই করার সাহস পাচ্ছিলাম না। এ সময় অনিক রাস্তায় নেমে হোসাইনকে পানি থেকে তুলে আমার কোলে দেয়। আমি শিশুটিকে আমার বাসায় নিয়ে প্রথমে শরীরে গরম তেল দেই। কিন্তু ওর নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়ায় ভয় পেয়ে যাই। স্থানীয় অনেক মানুষকে অনুরোধ করলাম শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেউ নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। পরে এক হিজড়াকে সঙ্গে নিয়ে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে চেষ্টা করেও ভর্তি করতে পারিনি। এরপর সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ডাক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমরা হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করি। সারা রাত দুই চোখের পাতা বুজতে পারিনি। শুধু বাচ্চাটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। রাতভর চিকিৎসার পর সকালে ডাক্তার বলেন, হোসাইন এখন মোটামুটি সুস্থ, তাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। পরে আমি জানতে পারি হোসাইনের দাদা ও নানা মিরপুর মডেল থানায় আছেন, সেজন্য আমি এখানে এসেছি। আমেনা বেগম বলেন, হোসাইনকে অনিকের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ বাঁচিয়েছেন।

শিশু হোসাইনের দাদা নিহত মিজানের বাবা নাসিরউদ্দিন হাওলাদার বলেন, আমার নাতিটা অনেক ছোট। এখনো বসা পর্যন্ত শেখেনি। ঢাকায় তাকে দেখাশোনা করার মতো তেমন কেউ নেই। নানি থাকলেও তার বয়স হয়েছে। তাই তাকে আমরা আমাদের বাড়ি ঝালকাঠিতে নিয়ে যাবো। সেখানে আমরাই তার দেখাশোনা করবো। ছেলে-বৌমাকে হারিয়েছি। এখন আর নাতিকে হারাতে চাই না। তাই তাকে সব সময় বুকে আগলে রাখবো।  শনিবার দুপুরে জানাজা শেষে  পারিবারিক কবরস্থানে তাদেরকে দাফন করা হয়।

অপরদিকে সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশ নেয়ার জন্য বসে থাকা অটোরিকশাচালক অনিকের পিতা বাবুল মিয়া বলেন, অনিক ওই ঝিলপাড় বস্তিতেই বাসা ভাড়া থাকতেন। ওই রাস্তার পাশেই তার বাসা। মানুষের চেঁচামেচি শুনে বাইরে আসে অনিক। রাস্তায় এসে দেখে পানির মধ্যে একটা শিশু পড়ে আছে। প্রথমে শিশুটিকে তুলে এক মহিলার হাতে দিয়ে অন্যদের বাঁচাতে এগিয়ে যায়। এ সময় তারও মৃত্যু হয়। একটা মহৎ কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ছেলে নেই। এখন তার এই মহৎ কাজটুকুই আমাদের সান্ত্বনা।

এদিকে বিদ্যুতায়িত হয়ে চারজনের মৃত্যুর বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, নিহতদের স্বজনরা আমাদের কাছে একটি অভিযোগ করেছেন অবহেলাজনিত কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগটি মামলা আকারে দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ না কি এই মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে, সব বিষয় নিয়েই আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্তের পরই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।

যেভাবে বেঁচে যায় শিশুটি
টানা বৃষ্টি, ঝড় ও জলাবদ্ধতায় বৃহস্পতিবার রাতে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল রাজধানীজুড়ে। বৃষ্টির মধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাসার দিকে ফিরছিলেন মিজান হাওলাদার (৩৫)। সঙ্গে ছিল স্ত্রী মুক্তা (২৫), লিমা (৭) ও সাত মাসের ছোট ছেলে হোসাইন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে মিরপুরে কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয় পরিবারের সকলের। তবে বেঁচে যায় ছোট্ট হোসাইন। সেইসঙ্গে পরিবারটিকে বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন একই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ অনিক (১৮) নামের এক কিশোর। আহত হোসাইনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান আমেনা ও হিজড়া বৃষ্টি।

শিশুটিকে উদ্ধারের বিষয়ে আমেনা  বলেন, ওই জায়গায় গিয়ে দেখি ছোট একটা গেঞ্জি ভাসতেছে। একজন গেঞ্জি তুলে দেখে বাচ্চা। হেয় বাচ্চাটাকে ছুড়ে দেয়। এরপর আরেকজন দেয় আমার কাছে। আমি ওকে নিয়ে জামা-কাপড় খুলে সরিষার তেল শরীরে মাখায় দেই। এরপর কম্বলে মুড়ে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাই।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *