অনুসন্ধানী সংবাদ

পেকুয়ায় ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্য : প্রতারিত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ

04 নাটোর 2112280915
print news

মোঃ আজিজুল হক,পেকুয়া প্রতিনিধি :

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রির কাজ করেন মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুম। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৩০টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেন। তবে উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় মোহাম্মদ আব্দুল  কায়ুমের নাম নেই। অনিবন্ধিত হয়েও কাজী হিসেবে প্রায় বছর ধরে কাজ চালিয়ে আসছেন তিনি।

গত শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ছৈয়দ নগর শিলখালীতে মনছুর আলমের বড়িতে কামিন রেজিষ্ট্রার করার সময় মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুমকে আটক করেন স্থানীয়রা। এ সময় একটি সরকারি বালাম ও কামিন রেজিস্ট্রারের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র পাওয়া যায়। মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুম উপজেলা মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন।

স্থানীয়রা বলেন, মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুম নিজেকে রেজিস্ট্রার কাজি হিসেবে দাবি করেন। আজকে তিনি আমাদের এলাকায় বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুম। এখন শুনি তিনি ভুয়া কাজী। তার মাধ্যমে যেসব বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হবে কিনা-সে চিন্তায় আছি।’

উপজেলা মসজিদের নিয়মিত এক মুসুল্লী বলেন, প্রতি শুক্রবার মসজিদে সর্বনিন্ম এক থেকে দুইটি বিয়ে হয়। বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এ ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনও বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়। সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন মোহাম্মদ কায়েম। অন্যান্য কাজীদের চেয়ে তিনি অর্ধেক টাকা কম রাখেন।

কেবল মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুম নয়, উপজেলায় কাজি পরিচয়ে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করছেনে আব্দুল হামিদ, ওমর ফারুক, নুরুল কবির, সালাাহ উদ্দিন, আবু বক্কর এ ছাড়া আদালতে কর্মরত মুহুরি রাসেল ও লতিফ কাজী পরিচয় দিয়ে বিবাহ রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন কার্যক্রম করছেন। তাদের ছত্রছায়ায় দেদার চলছে ভুয়া বিবাহ রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন।

একশ্রেণির দালাল ও এসব ভুয়া কাজী নিজেরাই সিল তৈরি করে কাবিননামার নকল বইয়ে বিবাহের রেজিস্ট্রি করছেন। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। এসব কাজী তাদের প্রয়োজনে নকল কাবিননামা, তালাকনামা ও বয়স প্রমাণের এফিডেভিটের ঘোষণাও দিচ্ছেন।এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন আতঙ্কে রয়েছেন তেমনি পরকীয়ার বলি হচ্ছে প্রবাসীদের সংসার। চক্রটি অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের বিষয়ে নির্বিকার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজী। যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর এখতিয়ার নেই।

কাজী হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এসব নামসর্বস্ব কাজীর ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। কিছু অসাধু দালালের সহায়তায় এসব ভুয়া কাজী বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এদের নির্দিষ্ট কোন অফিস নেই, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার, সরকার নির্ধারিত বালাম বইও। তবে সেটা ভুয়া। তাদের নেই আইনগত কোনো বৈধতাও। সেই সঙ্গে কাজীর নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও এসব কথিত কাজী পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর।

আবার অনেক সময় নিবন্ধনহীন ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি করে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। বিয়ের বৈধতা না থাকায় পরবর্তীতে তারা আইনগত সুবিধা পাচ্ছে না। বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালাইজেশনের আগে প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রশ্ন রয়েছে।কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার অনেক কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পেকুযা উপজেলায় রয়েছেন ৮ জন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে উপজেলায় যে সব কাজী রয়েছেন তারা অবৈধ। এ সংখ্যা প্রায় দশের উর্ধে। তাদের কোনো নিবন্ধনপত্র নেই।ভুয়া কাজীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী অ্যাডভোকেট হালিম বলেন, অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দন্ডবিধিতে আছে। দন্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজীর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজীর রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার শামিল।অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় ভুয়া কাজী ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।কাজীর তালিকা ও ভুয়া কাজীর শাস্তি না হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এটা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। অবিলম্বে মন্ত্রণালয়কে বিয়ে নিবন্ধক (কাজীদের) তালিকা, এরিয়ার তালিকা তৈরি করে অনলাইনে দিয়ে দেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে এই কাজটি এক মাসেই সম্ভব এবং তালিকার কপি, উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান এবং থানায়ও দিয়ে দেয়া যায়। খুব সাধারণ কাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় এমন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ উপেক্ষিত হয়ে আছে, এটা দুঃখজনক।

বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কক্সবাজার জেলা সমিতির সভাপতি কাজী শাহাদাতুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। রেজিস্ট্রি পদ্ধতি এখনো এনালগ রয়ে গেছে।ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা গেলে ভুয়া কাজী সনাক্ত করা সহজ হতো। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যেত। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক জনপদের অধিক্ষেত্রগুলোতে অনেক বয়স্ক নিকাহ রেজিস্ট্রার রয়েছে। তাদের অনেকেরই তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নেই।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, সরকারি তালিকার বাহিরে কোন ব্যক্তি নিকাহ সংক্রান্ত কোন কাজ করার বৈধতা রাখেনা। মোহাম্মদ আব্দুল কায়ুমের এই সব অবৈধ কার্মকান্ডের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

*গুরুত্বপূর্ণ  সব সংবাদ ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়।
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *