রামগড় বলিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সংস্কারের সরকারি কাজ বিক্রি


মোঃ সালাহউদ্দিন টিটো ,খাগড়াছড়ি : সরকারি টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পাওয়ার পর তা অন্য কোনো ঠিকাদারের নিকট বিক্রি করা নিয়ম বহির্ভূত। তবে সেই নিয়মের বালাই নেই খাগড়াছড়িতে। এখানে যে যার মতো করছে লাইসেন্স বাণিজ্য। কাজ না করেও শুধুমাত্র লাইসেন্সের বদৌলতে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন ঠিকাদাররা। বিপরীতে উচ্চদরে কিনে নেয়ার ফলে ঠিক থাকছেনা কাজের গুণগত মান। সম্প্রতি রামগড়ে একটি বিদ্যালয়ের মেরামত ও সংস্কার কাজে ঘটেছে এমনই এক তুঘলকি কান্ড। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বলিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কারের জন্য চলতি বছরের মার্চ মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। যার টেন্ডার আইডি নাম্বার-৭৯৯৯২৮, আর কাজের চুক্তিমূল্য ধরা হয় ১২ লাখ টাকা। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে সেই কাজটি পায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘আলমাস কনস্ট্রাকশন’। তবে কাজ পাওয়ার পর তা ২৫ শতাংশ লাভে অর্থাৎ ৩ লাখ টাকায় অন্য এক ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ৩ লক্ষ টাকায় কাজটি বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন মূল ঠিকাদার ‘আলমাস কনস্ট্রাকশান’ এর সত্ত্বাধিকারী মো. মোস্তফা। তিনি বলেন- ‘কাজটি সোহাগ চৌধুরী নামে খাগড়াছড়ির এক ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।১২ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যের কাজ ৩ লাখ টাকা লাভ দিয়ে কিনে নেয়ার পর সেই কাজের গুনগত মান ঠিক রাখা সম্ভব কী না কিংবা এভাবে কাজ নিজে না করিয়ে অন্য কারো কাছে বিক্রি করা কতোটা বিধিসম্মত —এমন প্রশ্নের উত্তরে মূল ঠিকাদার মো. মোস্তফা বলেন, ‘কাজের মান ঠিক থাকবে কী না তা উপ-ঠিকাদারের বিষয়। তিনি তো আমার সাথে দরদাম করেই কাজটি কিনে নিয়েছেন। এছাড়া আমার কাজ আমি কার কাছে বিক্রি করবো এবং কতো টাকায় বিক্রি করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।এদিকে কাজ বিক্রির বিষয়টি মূল ঠিকাদার স্বীকার করলেও তা অস্বীকার করেছেন উপ-ঠিকাদার সোহাগ চৌধুরী। তিনি বলেন- ‘আমি কাজটি কিনে নেইনি, আলমাস কনস্ট্রাকশানের হয়েই কাজ করছি আমি।এদিকে কাজের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ সমাপ্ত হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন রামগড় বলিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘এখনো অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।’ এছাড়া কাজ সমাপ্ত না করেই বিল উত্তোলনের পাঁয়তারা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে দুই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। খাগড়াছড়ি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রিসলি চাকমা বলেন, ‘আমরা শিডিউল অনুযায়ী কাজ বুঝে নিয়ে তারপর বিল দেবো।’ নিজে কাজ না করিয়ে উচ্চলাভে বিক্রির প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘কে কার কাছে কতো টাকায় কাজ বিক্রি করলো তা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’
আইন কি বলে:
সারাদেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দর-জনপদজুড়ে। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনে বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে কার্যাদেশপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারী ঠিকাদারদের কাজের হাতবদল বাণিজ্য। প্রভাব খাটিয়ে কাজ পাওয়ার পর আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ঠিকাদাররা দ্বিতীয় পক্ষের কাছে তা বিক্রি করে দেন। দ্বিতীয় পক্ষ অধিক টাকায় বিক্রি করে তৃতীয় পক্ষের কাছে। এভাবেই হচ্ছে হাতবদল। তৃতীয় পক্ষ লাভ করতে গিয়ে কাজের সঠিক মান ধরে রাখতে পারছে না। এতে মূল ঠিকাদার প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের ’ঘুষ’ দিয়ে বাজেটের বেশিরভাগ টাকা তুলে নেন। সাব-ঠিকাদার সময়মত টাকা না পাওয়ায় সময়ক্ষেপন করেন। এসব কাজে সংশ্লিস্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের তদারকিতে গাফিলতির খবর প্রায়শ খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রায় প্রতিটি সেক্টরে উন্নয়ন কাজ যেন সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের তেলেসমাতিতে বন্দি। ডিজিটাল পদ্ধতি এবং ই-টেন্ডার কোনো কাজে আসছে না; টাকা খরচ করে জি কে শামীম বা মিঠু সিন্ডিকেটের মতো ঠিকাদাররা কাজ বাগিয়ে নিয়ে বিলিবণ্ঠন আলোচনার পাদপ্রদীপে আসে। টেকসহ কাজ না হওয়ায় এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় মানুষকে। দেখা যায়,পথে নামলেই বিড়ম্বনা! নির্মানের কিছু দিনের মধ্যেই খানাখন্দে অনেক সড়ক হয়ে যায় মৃত্যুফাঁদ! কাজ অসমাপ্ত করে ফেলে রাখছেন ঠিকাদার বা তাদের সাব-কন্টাক্টররা। অনেকে কাজ বন্ধ রেখে লাপাত্তা হয়েছেন। সামান্য বৃষ্টি হলেই জনভোগান্তি। জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হওয়ায় মূল ঠিকাদার কাজ না করে সাব কন্ট্রাক্টে অন্যদের কাজ দিয়ে দেয়ায় সংকট তীব্র হচ্ছে। হাত বদল এবং নানা অবৈধ লেনদেনে উন্নয়ন প্রকল্পের একটি অংশ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাব-কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের যোগ্যতা যাছাই বাছাই করার সুযোগ থাকে না। মূল ঠিকাদারকে যত বেশি ছাড় দেয়া যাবে সেই সাব কন্ট্রাক্টরই কাজ পাবেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতেও প্রদান করতে হয় দুই থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ। এতে করে বাকি সত্তর শতাংশ অর্থ দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে ওঠে। অপরদিকে কাগজে পত্রে যেহেতু মূল ঠিকাদারই থাকে তাই বিল হয় মূল ঠিকাদারের নামে। মূল ঠিকাদার নানা পন্থায় প্রকল্পের বিল তুলে নেন। এতে সাব কন্ট্রাক্টর অনেক সময়ই অর্থের অভাবেও প্রকল্পের কাজে গতি আনতে পারেন না।
এদিকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ,কালভার্ট অফিস ভবন, কোর্ট কাচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ভবন- সবকিছুই নির্মিত হয় ঠিকাদার উপঠিকাদারদের মাধ্যমে? দেখা যায়,কেবল কাজ হাতবদলই নয়,আরো চলছে ঠিকাদারী লাইসেন্স ভাড়ার রমরমা ব্যবসা। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়ে লাইসেন্সধারীরা আবার অন্যদের ভাড়া দিয়ে দেয়। এভাবেই লাইন্সেন্স ভাড়া দিয়ে টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন তারা। এসব ঠিকাদাররা যে দলই ক্ষমতায় যায় তাদেরই তোষণ করে চলে। প্রয়োজনে দলও বদল করে ফেলে যদি তারা বুঝে দল বদলে ঠিকাদারী ব্যবসায় বেশি লাভবান হবে?
জানা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে ৪৯২ টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার,প্রকল্প কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলী তাদের রয়েছে আলাদা আলাদা অফিস ও বেতনভোগী জনবল। এসব জনবল থাকতে তবে কেন ঠিকাদার ও উপঠিকাদার প্রথা, টেন্ডার বেচাবিক্রির বানিজ্য এই প্রশ্ন সচেতন মহলে।
কোনো কোনো দপ্তর-সংস্থার কেনাকাটা পুরোপুরি ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় এখনো আসেনি। গুটিকয়েক ঠিকাদার শুধু গণপূর্ত অধিদপ্তর নয়, সরকারের প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থায় কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ (সওজ), শিক্ষাপ্রকৌশল (ইইডি), স্বাস্থ্য প্রকৌশল (এইচইডি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল (এলজিইডি) অধিদপ্তর, বিদ্যুত্ উন্নয়ন ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব ঠিকাদার সবচেয়ে বেশি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন।
একসঙ্গে দুটির বেশি কাজ পাবেন না ঠিকাদার:
একজন ঠিকাদার একসঙ্গে দুটির বেশি কাজ পাবেন না। কোনো ঠিকাদার যদি ওই দুটি কাজ সময়মতো শুরু ও শেষ করতে পারেন, তবে ভবিষ্যতে আরও কাজ পাবেন। এ ছাড়া একজন ঠিকাদার এক অর্থবছরে পাঁচ-ছয়টির বেশি কাজ পাবেন না। সরকারি ক্রয় আইন (২০০৬) ও সরকারি ক্রয় বিধিমালা (২০০৮) সংশোধনে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে, কোনো ঠিকাদার একই সময়ে একাধিক কাজ পেলে অনেক সময় কাজ বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয়; কাজের গুণগত মানও সঠিক থাকে না। এই আইন ও বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নামসহ কাজের বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে।কোনো ঠিকাদারকে একইসঙ্গে একাধিক প্রকল্পের কাজ দেওয়া যাবে না। চলমান প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে তারপর ওই ঠিকাদারকে অন্য কাজের নির্মাণাদেশ দেওয়া যেতে পারে।