হাসপাতালে বর্বর হামলা : কাঁদছে বিশ্ব


ইত্তেহাদ অনলাইন ডেস্ক : গাজায় এখন আর কোনো নিরাপদ স্থান নেই। সর্বত্র পড়ছে ইসরাইলি বোমা। আবাসিক ভবন, স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে।‘মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে’ দিগ্বিদিক ছুটছেন গাজার বাসিন্দারা। কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় গাজাবাসী।সেভ দ্য চিল্ড্রেন বলেছে, গাজায় ইসরাইলি বোমার আঘাতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি শিশু নিহত হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে আল আহলি হাসপাতালে বর্বর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। স্মরণকালে ভয়াবহ এ হামলায় হতবাক বিশ্ব। একে ‘নৃশংস যুদ্ধাপরাধ’ বলছে আরব বিশ্ব।এদিকে হাসপাতালে হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আরব নেতাদের পাশাপাশি পশ্চিমারাও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। তবে ইসরাইল বলছে, এর সঙ্গে তাদের সেনারা জড়িত নয়, এটি সশস্ত্র বাহিনী ‘ইসলামিক জিহাদের’ কাজ।জাতিসংঘ, রাশিয়া ও জার্মানিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এ ঘটনার পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। জরুরি বৈঠকে বসেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছে জর্ডানের বাদশাহ ও মিসরের প্রেসিডেন্ট।৭ অক্টোবর থেকে গেল ১২ দিনে গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৩৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৩ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। খবর আলজাজিরা, স্কাই নিউজ, নাইননিউজ, বিবিসি ও এএফপিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের।ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিনিধি নাবেল ফারসাখ বলেছেন, আল আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে নিহতদের অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা গাজার উত্তরাঞ্চলের মানুষ। জীবন বাঁচাতে তারা দক্ষিণ দিকে যাওয়ার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়েছিলেন।কিন্তু অর্থ ও পরিবহণের অভাবে তারা যেতে পারেননি। নিরাপদ স্থান ভেবে হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। তাদের বিশ্বাস ছিল, অন্তত হাসপাতালে বোমা পড়বে না। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ভুল।হামাস দাবি করেছে, মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে ওই বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে একদিনে একক হামলায় সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি দেখল গাজা।গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, হাসপাতালটিতে অসুস্থ রোগী ও আশ্রিত মানুষ ছাড়া আর কেউ ছিল না। এটা নৃশংস গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ। এছাড়া বুধবার উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে পৃথক ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছেন।একজন চিকিৎসক বলেছেন, এ হাসপাতালকে টার্গেট করার আগে কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। প্রায় তিন হাজার মানুষ ভেতরে ছিলেন। কী দিয়ে হামলা হয়েছে জানি না। শিশুদের শরীর ছিন্নভন্ন হয়ে গেছে।আরেক বাসিন্দা বলেন, যারা মারা গেছে সবাই বেসামরিক। তাদের কোনো অস্ত্র ছিল না। বুধবার অনেক স্বজনকে প্রিয়জনের লাশ খুঁজতে গিয়ে লাশের টুকরোগুলো সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।গাজা থেকে আলজাজিরার সাংবাদিক হাসান আসলিহ বলেছেন, আল আহলি হাসপাতালে বিমান হামলায় বেশিরভাগ নিহতই পুরুষ ও শিশু। নারী ও সদ্যোজাতরা হাসপাতাল ভবনের ওপরের তলায় ঘুমাচ্ছিলেন। বেশিরভাগ শিশু ও পুরুষ হাসপাতালের মাঠে ঘুমান। যে কারণে তাদের মধ্যেই নিহতের সংখ্যা বেশি।জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, আমি বাকরুদ্ধ। শত শত মানুষের মৃত্যু হলো। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সংঘাত ও হত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে। প্রভাবশালী দেশগুলোর এজন্য চেষ্টা করা উচিত। বেসামরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক সহায়তা পৌঁছানোরও সুযোগ দিতে হবে।গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কিদরা বলেছেন, আল আহলি হাসপাতাল অ্যাংলিকান গির্জার সঙ্গে যুক্ত একটি ঐতিহাসিক হাসপাতাল। এখানে অনেক বাস্তুচ্যুত পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। আমরা লাশগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেক লাশ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এজন্য গণনা করতেও বেগ পেতে হচ্ছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গাজা পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গেল ৭ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে গাজার ১১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছোট-বড় হামলা হয়েছে।দেশে দেশে বিক্ষোভ-নিন্দা, পঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত দাবি: হাসপাতালে হামলার দায় অস্বীকার করেছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। আইডিএফ দাবি করেছে, গাজার আরেক সশস্ত্র বাহিনী ইসলামিক জিহাদের একটি ব্যর্থ রকেট আঘাত হানার পর ওই হাসপাতালে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।এ নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, হামলার সঙ্গে ইসরাইল জড়িত ছিল না তা প্রমাণ করতে ইসরাইলকে অবশ্যই স্যাটেলাইট ছবি সরবরাহ করতে হবে। রাশিয়া নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এই আঘাত ভয়াবহ অপরাধ ও অমানবিক কাজ। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণের ছবি দেখে আমি আতঙ্কিত।এ হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা উচিত। তিনি জানান, ইসরাইল, জর্ডান ও মিসরের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর শিগগিরই গাজায় মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়া। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আরব লীগ, সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান, কাতার, ইরান, আরব আমিরাত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।ইসরাইল গণহত্যা করছে-মাহমুদ আব্বাস: ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস টিভিতে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, হাসপাতালে হামলার মাধ্যমে ইসরাইল চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। তারা ভয়াবহ গণহত্যা করছে। আমরা আমাদের ভূমি ছেড়ে কোথাও যাব না এবং কাউকে আমাদের উচ্ছেদও করতে দেব না।বুধবার জর্ডানের রাজধানী আম্মানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি ও জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ-২ এর সঙ্গে তার বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু হাসপাতালে হামলার পর বৈঠক বাতিল করে ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন মাহমুদ আব্বাস।
জর্ডানে ইসরাইলি দূতাবাস ঘেরাও: জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ইসরাইলি দূতাবাস ঘেরাও করেছেন সাধারণ মানুষ। এ সময় অনেকে দূতাবাসের ভেতর ঢুকে হামলার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরাইলের দূতাবাসের সামনে জড়ো হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে অনেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বাধা দেয়।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান জাতিসংঘের: জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।তিনি হাসপাতালে হামলার নিন্দাও জানান। বুধবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্পের একটি ফোরামে তিনি বলেন, আমরা যে ভয়াবহ মানবিক যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করছি তা বন্ধ করতে অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছি।রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি হ্যাক করে সতর্কবার্তা ইসরাইলের: গাজায় ইসরাইলি হামলা শুরুর পর থেকে তারা স্থানীয় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি হ্যাক করে সতর্কবার্তা প্রচার করছে। তারা সাধারণ মানুষকে উত্তর গাজা ছাড়তে নির্দেশ দিচ্ছে। তবে এতে মোটেও ভীত হন গাজার বাসিন্দারা।ইবরাহীম নামে উত্তর গাজার এক বাসিন্দা বলেন, আমরা জানি গাজার কোথাও ইসরাইলি বোমা হামলা থেকে নিরাপদ নয়। তাই আমরা নিজ শহর ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। প্রয়োজনে বাড়িতেই মারা যাব।ইরানের হুঁশিয়ারি, ‘সময় শেষ’: ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন, গাজার হাসপাতালে কমপক্ষে এক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী। যা আইএসের কর্মকাণ্ডের চেয়েও ঘৃণ্য অপরাধ। সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে এক হওয়ার। টাইম ইজ ওভার (সময় শেষ)।হাসপাতালে হামলা কি গণহত্যা: জেনেভা কনভেনশন অনুসারে, যুদ্ধের সময় অসুস্থ এবং আহতদের পাশাপাশি চিকিৎসাকর্মী, হাসপাতাল ও মোবাইল চিকিৎসা সুবিধাগুলো সুরক্ষিত থাকে। কোনো অবস্থাতেই তারা আক্রমণের উদ্দেশ্য হতে পারে না এবং এ ধরনের লক্ষ্যবস্তু করা যুদ্ধাপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।
গাজার হাসপাতালে হামলায় নিন্দা
মঙ্গলবার রাতে মধ্য গাজার আল-আহলি আরব নামের হাসপাতালে সতর্কবার্তা ছাড়াই ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালায়। এতে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, ইসরাইল যে ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধেরও তোয়াক্কা করছে না, গাজায় হাসপাতালে হামলা এর সর্বশেষ উদাহরণ। গাজায় ‘নজিরবিহীন নৃশংসতা’ বন্ধে সবার প্রতি তিনি আহ্বান জানান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইলি বাহিনী নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়ে গাজার নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষকে হত্যা করছে। জঘন্য এ অপরাধের মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্রটি আরেকবার বিশ্বের সামনে তাদের অমানবিক ও পাশবিকতাকেই তুলে ধরেছে। হাসপাতালে ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার।
গাজার হাসপাতালে হামলায় নিন্দা জানিয়েছে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন আরব লিগ। সংস্থাটির প্রধান আহমেদ ঘেতি বলেছেন, বিশ্বনেতাদের অবিলম্বে এ ‘ট্র্যাজেডি’ বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি বৈঠকে বসার জন্য অনুরোধ করেছে রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। গাজার হাসপাতালে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানোম গেব্রিয়াসুস। অবিলম্বে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনাকে ‘ভয়ংকর’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র–ডো। তিনি বলেন, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি আছে। কোনো হাসপাতালে এভাবে হামলা করার ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। হাসপাতালে প্রাণঘাতী হামলার নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্সও।
* দেশ বিদেশের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।