শত চ্যালেঞ্জ নিয়ে চেয়ারে বসবেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র খোকন


অনলাইন ডেস্ক : আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। মেয়রের চেয়ারে বসতে না বসতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন নানামুখী বিতর্কে।নির্বাচনের আগে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও নগরে সমস্যা সৃষ্টি ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেননি সাদিক আব্দুল্লাহ- এমন অভিযোগ নগরবাসীর। তার মেয়াদে ৫৭ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার সড়ক বাতি ওজোপাডিকো বন্ধ করে দেয় একাধিকবার। সিটি করপোরেশন বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় নগরবাসীকে।পাশাপাশি তার মেয়াদকালের শেষ সময়ে অপরিকল্পিতভাবে পাঁচ হাজার ব্যাটারীচালিত অটোরিকশার অনুমোদন আর কাউনিয়ায় অবৈধভাবে প্লট বিতরণ করে বিতর্কের শীর্ষে পৌঁছে যান মেয়র সাদিক।এমনটা বলছেন বরিশালের সচেতন সমাজ। তারা বলছেন, ১৪ নভেম্বর মেয়রের চেয়ারে বসতে যাওয়া আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নগর ভবনে চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনা এবং মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নগরী ঢেলে সাজানো।বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত ও শপথ গ্রহণের দীর্ঘ সময় পর ১৪ নভেম্বর মেয়র পদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তবে তার সামনে শত চ্যালেঞ্জ আর সমস্যার জঞ্জাল রয়েছে, যা দায়িত্ব গ্রহণের পর সমাধান করতে বেশ বেগ পেতে হবে তাকে।
ভবনের ছাদে হয়েছে কাশবন। এই বেহাল দশার মধ্যেই নতুন মেয়র দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন আগামী ১৪ নভেম্বর। কর্মচারীদের অনেকের দাবি, নতুন মেয়র দায়িত্ব নেয়ার আগেই তাকে নানামুখী চাপে ফেলতে চাচ্ছেন বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। নগর ভবনে মেয়রের ব্যবহারের জন্য থাকা নানা আসবাবপত্রও উধাও হয়ে গেছে।প্রায় কয়েকশো অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ দেয়া, অনেক কর্মচারীর বেতন বাড়ানো, কারো কারো পদন্নোতি দেয়া, হুট করেই হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোসহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি ও নগর ভবনকে ভঙ্গুর করার অভিযোগ উঠেছে বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘নগরবাসীর মধ্যে নানা ধরনের সংশয়-দ্বিধা রয়েছে। নতুন মেয়রকে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সেগুলো দূর করতে হবে। কেননা তার কাছে বরিশালবাসীর বিশাল আশা।‘বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল নগরীর তেমন কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর সিটি করপোরেশনের চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়েছে। নগর ভবনের যে বেহাল দশা তাতে করে নগর ভবনকে সুন্দর করে না সাজালে নগরবাসী সুবিধা নেবে কোন জায়গা থেকে?মানুষ জানেই না বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কে! সব জায়গায় অব্যবস্থাপনা আর খামখেয়ালিপনা। এসব নিয়মের মধ্যে আনতে হবে নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতকে।’বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদের বাসচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাদিক আব্দুল্লাহ এক সময় বলেছেন যে বাস টার্মিনাল বড় করবেন। তা অন্য জায়গায় নেবেন। আসলে তিনি কিছুই করতে পারেন নাই। টার্মিনালের মধ্যে বাস নিয়ে ঢুকলে কিভাবে বের হওয়া যায় সেই চিন্তায় থাকা লাগে সবার আগে। জায়গার তুলনায় বাসের সংখ্যা অনেক বেশি।‘তাছাড়া বাস টার্মিনাল ভবনেরও বেহাল দশা। অন্যত্র সরানোটা অনেক দীর্ঘ ব্যাপার। তবে বাস টার্মিনালের ভেতরের সড়ক সংস্কার করে একটা নিয়মের মধ্যে সবকিছু আনা গেলে বেশ ভালো হতো। বিশেষ করে চাঁদাবাজি যদি নতুন মেয়র বন্ধ করতে পারেন তাহলে শ্রমিকরা খুশি হবে।’বরিশালের রূপাতলী বাস টার্মিনালের শ্রমিক ইদ্রিস মিয়া বলেন, ‘হালকা বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানির জমে যায় পুরো টার্মিনাল এলাকায়। এ কারণে অনেক বাস বাধ্য হয়ে মূল সড়কে থাকে। এতে করে সাধারণ মানুষের বেশ সমস্যা হয়। শুধু তাই নয়, টার্মিনাল ভবনের অবস্থাও বেহাল। রূপাতলী ও নথুল্লাবাদ এই দুই বাস টার্মিনালের দিকে মেয়রকে বিশেষ নজরে আনতে হবে।’বরিশাল নগরীর একটি স্কুলের শিক্ষক অশোক মৈনাক বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রয়েছে। এটা নগরবাসীর কাছে পরিষ্কার। নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তবে তিনি কতটুকু পূরণ করতে পারেন সেটা তার বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করবে।‘নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতকে শক্তিশালী বলয় গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ করপোরেশনে যে বলয় তৈরি করেছেন তা ভাঙা কষ্টকর হয়ে যাবে। মূল সড়কগুলো ঠিক করেই কাজ সেরেছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। নগরীর অলিগলির দিকে তিনি কোনো নজর দেননি। সেই অলিগলি তথা রাস্তাঘাট, ড্রেন আর খাল সংস্কারের দিকে খোকন সেরনিয়াবাতকে খেয়াল রাখতে হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত দায়িত্ব নিবেন আগামী ১৪ নভেম্বর। তবে চলে যাবার আগেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে। নতুন মেয়রকে চাপে ফেলতে অস্থায়ী কয়েকশো কর্মচারী নিয়োগ, নগর ভবনের এসি ও সোফাসেট থেকে শুরু করে নানা আসবাবপত্র উধাওসহ সিটি করপোরেশনকে ভঙ্গুর করে রেখে যাবার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের তৃতীয় তলার কনফারেন্স রুম যেন কোনও যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঘর। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ডেকোরেশন সিলিং খুলে পড়ে রয়েছে। সিঁড়ি থেকে যতোই ওপরে উঠা যাবে, ততোই দেখা যাবে বেহাল অবস্থার দৃশ্য। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়ছে।
আব্দুর রশিদ নামে অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনে অযোগ্য লোকবল নিয়োগ দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করিয়েছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করে মানুষকে প্রথম বড় ধরনের হয়রানির মধ্যে ফেলেছিলেন এই মেয়র।‘তিনি ৩/৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়েই সব কাজ করাতেন। কোনো ওপেন টেন্ডার ছাড়াই নিজের লোকজন দিয়ে খেয়ালখুশিমতো সব কাজ করাতেন সাদিক। আর কাজ শেষ না করেই নিজের ঠিকাদারদের বিলও দিয়ে দিতেন তিনি। যে কারণে অনেক এলাকাতেই অসম্পন্ন কাজ থাকায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।’কলেজ শিক্ষক সোহরাব মৃধা বলেন, ‘নগরীর হাতেম আলী কলেজ চৌমাথাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতে অবৈধ দোকান বসিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন মেয়র সাদিকের অনুসারীরা। খোদ নগর ভবনের সামনেই ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চলতো।’বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল আলম স্বপন বলেন, ‘যান্ত্রিক শাখায় অনেক গাড়ি মালামালের অভাবে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, খোদ মেয়রের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়িটিও অকেজো অবস্থায় রয়েছে। তবে কোথায় রয়েছে তা জানি না।‘শেষ সময়ে বিধিবহির্ভূত প্ল্যান পাস করা শুরু হয়েছে। বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে প্ল্যান পাসের নামে। নগরীতে পাঁচ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। নগরীতে এতে কী পরিমাণ যানজটের সৃষ্টি হবে তার কোনো ধারণা নেই করপোরেশনের। এই অটো দিয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছে অনেকে।’সুশাসনের জন্য নাগরিক বরিশালের সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, ‘নতুন মেয়র ১৪ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তার প্রথম কাজ হবে নগর প্রশাসন ঠিক করা। কেননা বর্তমানে যে অবস্থা করে রাখা হয়েছে তা ঠিক করতে হবে। ট্যাক্স পুনঃনির্ধারণ করার পাশাপাশি জনবল কমাতে হবে।‘সবাইকে দেখানোর জন্য নয়, নতুন মেয়রকে পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে হবে। জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ ও রাস্তা ঠিক করতে মাস্টার প্ল্যান করতে হবে। প্রথমেই খাল ও জলাশয়গুলোকে উদ্ধার করতে হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘আগের মেয়রের সমর্থক কাউন্সিলররা নতুন মেয়রকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করবেন। সেগুলো মাথায় রাখতে হবে। বাস টার্মিনাল দুটিকে আপাতত সংস্কার করতে হবে। প্রাথমিকভাবে যদি এসব সমস্যার সমাধান করা যায় তাহলে বাকিটা পথ মসৃণ হবে বলে আশা করছি।’বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব বলেন, ‘নবনির্বাচিত মেয়র যাতে করপোরেশনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার সব ব্যবস্থাই করছেন বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। পুরো প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছেন তিনি। মাস্টার রোলের কর্মচারী প্রকৌশলীকে তুই-তোকারি করে কথা বলেন। তার অনুসারীদের সিটি করপোরেশনে চাকরি দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করিয়েছেন।‘জনগণের টাকা লুটপাট করেছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে চাঁদাবাজি করা হয়েছে নগরজুড়ে। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে যারা একটি ভবন নির্মাণের উদ্যেগ নিয়েছেন তাদের কাছ থেকেই চাঁদা নেয়া হয়েছে।’এই কাউন্সিলর আরও বলেন, ‘মানুষের কান্নার ওপর টাকা নিয়েছেন সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা। এখন ব্যাক ডেটে চিঠি ও চেক সাইন করে অর্থ আত্মসাতের মিশনে নেমেছেন বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। বিরুদ্ধে কথা বললেই তার বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করা হতো। আমরা নতুন মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের নেতৃত্বে নতুন বরিশাল উপহার দেবো সবাইকে।’এসব বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘আমি জানি শত সমস্যার জঞ্জাল মাথায় নিয়ে আমাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হচ্ছে। তবে এই জঞ্জাল আমি পরিষ্কার করবো বরিশালবাসীকে সঙ্গে নিয়ে।‘নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সব মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী করবো। দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনৈতিক হিসাবের দিকে প্রথমে নজরে দেবো। অডিট করানো হবে। আর হিসাবে কোনো গরমিল পাওয়া গেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সিটি করপোরেশনের টাকা ইচ্ছামতো খরচ করা যায় না। কারণ এটা জনগণের, কারও ব্যক্তিগত নয়।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
অব্যাহতি নিচ্ছেন মেয়র সাদিক, দেখা হবে না চাচা-ভাতিজার : চারদিন মেয়রশূন্য থাকবে বরিশাল নগরভবন - ইত
নভেম্বর ৬, ২০২৩[…] […]