মতামত

যখন প্রশ্ন ওঠে কী লিখব

image 756337 1703715175
print news

ড. মাহবুব উল্লাহ্ :

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মৃত্যু-পরবর্তী দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল বারিধারা জামে মসজিদে। এটি নান্দনিকভাবে সুন্দর একটি মসজিদ। মসজিদটির অবস্থান ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বারিধারার বাসভবনের ঠিক বিপরীতে। দোয়া মাহফিলে রাজধানী ঢাকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বাদ আসর দোয়া মাহফিলটি অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম সাহেব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে খাস নিয়তে দোয়া করেন। উপস্থিত মুসল্লিরা অন্তরের অন্তস্তল থেকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।

দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একমাত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রেসিডেন্ট এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তিনি নিজেই জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে আরেকটি দল গঠন করে এর নেতা হয়ে যান। তার দলটি খুবই ক্ষুদ্র। তবে সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজ এলাকা কাউখালী, ভান্ডারিয়া ও জিয়ানগর সংসদীয় আসন থেকে একাধিকবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিশেষ করে ভান্ডারিয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং বারবার জতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে তিনি বিশেষভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের কাজে সহায়তা করতেন। ওই সময় তার পিতা প্রখ্যাত সাংবাদিক ও দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কারারুদ্ধ ছিলেন এবং দৈনিক ইত্তেফাকও বেআইনি ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৬৯-এর আন্দোলনের একপর্যায়ে দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, একই বছর ১ জুন তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে ইন্তেকাল করেন। ১৯৬৯-এর আন্দোলনের নেতারা তাদের যাতায়াতের প্রয়োজনে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার গাড়িটি ব্যবহার করতেন। গাড়ি চালাতেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সেই থেকে জনাব মঞ্জুর সঙ্গে আমার গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। আমরা অনেক সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করতাম। মঞ্জু বুদ্ধিদীপ্ত পয়েন্ট উত্থাপন করত। মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালনকালেও মঞ্জু চমৎকারভাবে তার উপস্থিত বুদ্ধি ব্যবহারে সক্ষম হতো।

মনে পড়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনে প্রফেসর আনিসুজ্জামান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন। আমরা বেশ কজন শিক্ষক স্থির করেছিলাম প্রফেসর আনিসুজ্জামানেরই উপাচার্য হওয়া উচিত। এজন্য আমরা কজন ঢাকায় এসে তার পক্ষে তদবির করেছিলাম। তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য। উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা তার হাতেই ছিল। ঢাকায় এসে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হলো। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, সে যেন এরশাদের কাছে প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে উপাচার্য পদে নিয়োগদানের জন্য অনুরোধ করে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলল-ভালোই হলো, আজ দুপুরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার লাঞ্চ করার কথা। এ সুযোগে সে বিষয়টি প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করবে। যথারীতি সে কাজটি করল। এতে প্রেসিডেন্ট এরশাদ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আমার দেহে শেষ রক্তবিন্দু থাকতে প্রফেসর আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারবেন না। তিনি আমাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করে বেড়ান। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের উপাচার্য হওয়ার বিষয়টি এখানেই থেমে গেল। নৈতিকতার দিক থেকে এ ধরনের তদবির গ্রহণযোগ্য ছিল না।

মরহুম ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের দোয়া মাহফিলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর আমার সরাসরি দেখা হলো। মঞ্জু খুব উৎফুল্ল হয়ে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। আমি তাকে জানালাম, মোটামুটি আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। তবে তুমি কেমন আছ? তোমাকে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। শরীরের ওজনও অনেকটা কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগের দিন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের জানাজায় মঞ্জু উপস্থিত ছিল। তাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হলে সে প্রায় নির্বাক থাকে। তার চোখের কোণে অশ্রুরেখা দেখা দেয়। স্পষ্টতই সে অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল। এ কারণে কোনো কথা উচ্চারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শারীরিক দুর্বলতাও স্পষ্ট ছিল। তাকে ২-৩ জন সাহায্যকারী ধরে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানের আগে সে আমাকে দেখে প্রশ্ন করেছিল, আজকাল তোমার লেখা দেখি না কেন? একসময় ইত্তেফাকসহ একাধিক পত্রিকায় আমি কলাম লিখতাম, এখন একাধিক পত্রিকায় লেখা কষ্টকর মনে হয়। তাই নিয়মিতভাবে শুধু যুগান্তরে লিখি। এছাড়া মাঝেমধ্যে সমকালেও লিখি। আমি জানি, লিখতে চাইলে কোনো পত্রিকার সম্পাদকই আমাকে না করবেন না। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম-যুগান্তরে আমার নিয়মিত কলাম কেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে? এর দায় কার? আমার, না যুগান্তরের? এখন বড় দুঃসময়। সংবাদপত্রে মন খুলে কিছু লেখা যায় না। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খড়্গ প্রতিনিয়ত লিখিয়েদের মাথার ওপর ঝুলছে। একটু এদিক-সেদিক হলে দীর্ঘদিন বিনা বিচারে কয়েদ ভোগ করতে হবে। আদালত থেকে জামিন পাওয়া অনিশ্চিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা একই আইনে দীর্ঘ এক বছর কারাভোগের পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জামিন পেয়েছে। সময়মতো জামিনের নির্দেশনা কারাগারে না পৌঁছানোর ফলে তাকে পরীক্ষা বিভ্রাটে পড়তে হয়েছে।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি লিখছ না কেন? আমি বলেছিলাম, কী লিখব? যা কিছুই লেখার চিন্তা করি, তা প্রায়ই প্রচলিত আইনের বেড়াজালে পড়ে যেতে পারে। যৌবনে জেল ভোগ করতে কুণ্ঠাবোধ করিনি। সামরিক আদালতে বেত্রদণ্ডের নির্দেশ সত্ত্বেও ক্ষমাভিক্ষা করিনি। মাথা উঁচু রেখেছিলাম। বুকে ছিল অপরিসীম সাহস। মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করতে কম্পিত হইনি। কিন্তু এখন শেষ বয়সে এসে দেহে নানা রকম রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। বয়সের ভারে কিছুটা হলেও ন্যুব্জ হয়ে গেছি। বৃদ্ধ বয়সে কিছু সত্য কথা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা ভাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশ নাকাল হয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন মহল থেকে তার ওপর বিদ্রুপের বিষাক্ত হুল ফোঁটানো হয়েছিল। সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও কম হয়রানির শিকার হননি। তাই কী লিখব-এমন কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলে উঠেছিল, কথাটি তো ঠিক। তাহলে লিখ, কী লিখব-এই নিয়ে।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশিষ্ট নাগরিক মরহুম ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন কথা বলার জন্য ৩ মাস কারাভোগ করেছেন। কারাগারে প্রবেশের পর তাকে মেঝেতে শয্যা গ্রহণ করতে হয়েছিল। যে মানুষটি চিরকাল আরাম-আয়েশের মধ্যে জীবনযাপন করেছেন, ইত্তেফাকের মতো পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন, যিনি সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যিনি বাংলাদেশের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার প্রিয় সন্তান, তাকে কেন এত দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে! যতদূর জানি, তার সামাজিক মর্যাদার কারণে তিনি কারাগারে প্রথম শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। তার মতো মানুষকে একটি কথা বলার জন্য এত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আমাদের মতো মানুষ তো কোন ছার! কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেন। এ দুরারোগ্য ব্যাধিতেই তার মৃত্যু হয়।

আমাদের সৌভাগ্য যে, মৃত্যুর আগে তিনি ২-৩টি গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এ গ্রন্থগুলোর ওজন ও ভার অপরিসীম। তিনি নির্ভীক চিত্তে গণতন্ত্রের একজন লড়াকু সৈনিক হিসাবে এ গ্রন্থগুলোয় যা কিছু লিখেছেন, তা আমাদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। গণতন্ত্রের সৈনিকরা এ গ্রন্থগুলো থেকে প্রেরণা পাবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচারভ্রমণলাইফস্টাইলক্যারিয়ারতথ্যপ্রযুক্তিকৃষি  প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *