দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফিটনেসবিহীন ফেরি চলাচল : ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা


রাজবাড়ী প্রতিনিধি : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌরুট। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ সহজে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের যাতায়াতের জন্য এই নৌরুট ব্যবহার করে থাকে। এই নৌরুট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন ও যাত্রী পারাপার হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু চালু হবার আগে এই নৌরুটের যে পরিমাণ চাপ ছিল, এখন সেই চাপ না থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা সহজে রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য এই রুট ব্যবহার করে থাকে। তবে এই নৌরুটে চলাচলকারী বেশিরভাগ ফেরিই ফিটনেসবিহীন এবং কয়েক বছরের পুরনো। যার ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে চলাচলকারী অধিকাংশ ফেরির ফিটনেস নেই। আবার কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচলের জন্য ৫ কোটি টাকা খরচ করে যেসব ফগ লাইট বসানো হয়েছিল, সেটিও বিকল হয়ে পড়ে আছে। এসব কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে প্রায়ই ঘটছে নানা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এতে একদিকে ঘটছে প্রাণহানি, অপর দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।গত বুধবার (১৭ জানুয়ারি) সকালে কুয়াশায় আটকে থাকা ছোট ইউটিলিটি ফেরি ‘রজনীগন্ধা’র তলা ফেটে পানি উঠে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটের অদূরে ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধা ফেরিটিরও ফিটনেস ছিল না বলে ফেরিতে থাকা ট্রাকের চালক ও হেলপাররা অভিযোগ করেছেন।
এর আগে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ‘আমানত শাহ’ নামের একটি ফেরি ১৭টি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে পাটুরিয়ার উদ্দেশ্য গেলে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরি ঘাটের কাছে ডুবে যায়। সেই ফেরিও ফিটনেসবিহীন ছিল। ফেরিটি প্রায় ৪১ বছরের পুরাতন ছিলো। সর্বশেষ ২০১২ সালে ডকিং মেরামত হয়েছিল আমানত শাহ ফেরিটির। এরপর থেকে কোনো ফুল ডকিং করা হয়নি। এছাড়া কোনো সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল না ফেরির। ফলে ফেরিটি চলাচলের অনুপযুক্ত ছিল।
জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের অধিকাংশ ফেরির বয়স ৩৫ বছরের বেশি। রজনীগন্ধার বয়স ছিল ৪৭ বছরের বেশি। রোরো ফেরি ‘খান জাহান আলী’ তৈরি হয় ১৯৮৭ সালে। আরেক রোরো ফেরি ‘কেরামত আলী’ ৩৬ বছরের পুরনো। ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ফেরি তৈরি হয় ১৯৯২ সালে।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, এই সংস্থার আওতাধীন ৫৩ ফেরির মধ্যে ৪৭টিরই সনদ নেই। বেশিরভাগ ফেরি ৪০ বছরের বেশি পুরাতন। এছাড়াও ১৮টি রোরো ফেরির (বড় ফেরি) মধ্যে ১৪টিরই ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়াও নেই বেশির ভাগ ফেরিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী ৪০ বছরের বেশি বয়সী নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয় না বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। তারপরেও চলছে ফেরি সার্ভিস। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ফগ লাইট বসানো হয়। একেকটি ৭ হাজার কিলোওয়াটের লাইট কিনতে ৫০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়।
এই নৌরুটের খান জাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত, কপোতি, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত ও শাহ পরান ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট বসানো হয়। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ছোট-বড় ১৬টি ফেরি চলাচল করে। এসব ফেরিতে ১৭ থেকে ১৮শ যানবাহন পারাপার হয়। কিন্তু কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৩ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্তও ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে।
কয়েকজন ফেরি মাস্টার জানান, প্রতিটি ফেরির বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। নাব্যতা সংকটের কারণে ধীরে ধীরে চললেও কুয়াশার কারণে প্রতিদিনই ৩ থেকে ১২ ঘণ্টা ফেরি বন্ধ রাখতে হয়। ফগ লাইট লাগানো হলেও তা কাজে আসেনি। নদীপথ অস্পষ্ট হয়ে গেলেই ফেরি বন্ধ করে দেয় ঘাট কর্তৃপক্ষ। অথচ কোটি টাকা খরচ করে এই কুয়াশার কারণে ফেরিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফগ লাইট লাগানো হয়েছিল, যা কোনো কাজেই আসছে না।
গত ১৭ জানুয়ারি রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির দুর্ঘটনার দিন ওই ফেরির আরোহী ছিলেন ট্রাকচালক আশিক। তিনি বলেন, ফেরিটির কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগেনি। তলা দিয়ে পানি ঢুকে কাত হয়ে ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যায়। ফেরিটি অনেক পুরাতন ও ফিটনেসবিহীন ছিল। এছাড়াও ফেরি কর্তৃপক্ষ অবহেলার কারণে রজনীগন্ধা ফেরিটি ডুবে যায়।
রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির প্রত্যক্ষদর্শী আরেক ট্রাকের চালক মজনু বলেন, রাতে দৌলতদিয়া থেকে রওনা হবার পর মাঝ নদীতে এসে কুয়াশার কারণে ফেরি নোঙর করে রাখা হয়। পরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ফেরিতে পানি উঠতে থাকে। এ সময় ফেরির লোকজন পানি নিষ্কাশন করার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে ফেরিটির এক পাশ কাত হয়ে ডুবতে থাকে। এক পর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিকে সব মালবাহী ট্রাক নিয়ে ফেরিটি পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় আমরা যে যার মতো জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠি। ফেরিটির সঙ্গে কোনো বাল্কহেডের ধাক্কা লাগেনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ বলেন, এ নৌরুটে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ফেরি নেই। ফেরি রজনীগন্ধার কাগজপত্র সব ঠিক ছিলো, ফিটনেস ছিলো, সার্ভে ছিল। অনেকেই বলেছে যে ফিটনেস ছিল না। তারা এটা না জেনে বলেছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ৯টি রো-রো ফেরি, ৩ টি ইউটিলিটি ফেরি, ১ টি কে-টাইপ ফেরি ও ৩ টি ছোট ফেরি রয়েছে। প্রত্যেকটি ফেরিরই ফিটনেস কাগজপত্র ঠিক রয়েছে।
বাল্কহেডের ধাক্কায় ফেরিটি ডুবেছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকে অনেক কথা বলেছে। ঘটনাস্থলে কেউই ছিল না। বিভিন্ন কথার পরিপেক্ষিতে এগুলো আলোচনায় আসছে। যেহেতু এখন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত চলছে সেহেতু আমরা প্রকৃত কারণ জানতে পারবো। অনেকেই বলেছে প্রচণ্ড শব্দ হয়েছে, ট্রলার অথবা বাল্কহেড ধাক্কা লেগে ডুবেছে। এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত অথবা আশেপাশের লোকের বা স্থানীয়দের কথা ছিলো। তদন্ত প্রতিবেদন আসলে মূল কারণ জানা যাবে।
কোটি টাকার ফগ লাইট অকেজো হবার বিষয়ে জানতে বিআইডব্লিউিটিসি’র ডিজিএম শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ বলেন, আসলে ফগ লাইটগুলো পরীক্ষামূলকভাবে লাগানো হয়েছিল। মূলত হালকা কুয়াশার মধ্যে এই ফগ লাইট কাজে লাগে, কিন্তু ঘন কুয়াশা হলে এই ফগ লাইট কোনো কাজে আসে না। বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক মো. শাহজাহান জানান, রজনীগন্ধা ফেরি ডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় এসেছে। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা, রুস্তম ও প্রত্যয়ের সমন্বয়ে ফেরিটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, পাঁচ বছরে একবার ফেরির ডকিং করতে হয়। রজনীগন্ধা ২০২১ সালে ডকিং হয়। আর ফগ লাইটের বিষয়ে মন্ত্রী কথা বলেছেন, আমি কিছু বলব না। আর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর ফেরিডুবির কারণ সম্পর্কে বলা যাবে। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ড. এ. কে. এম মতিউর রহমান বলেন, প্রত্যয়ের সঙ্গে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তমও কাজ করবে ফেরি উদ্ধারে। এই তিনটির সমন্বয়ে ফেরিটি উদ্ধার করা সম্ভব না হলে অবশ্যই অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটি আমাদের পরিকল্পনা করা আছে। ফেরির ফিটনেস ও দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে রজনীগন্ধা ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ২০জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। রজনীগন্ধার দ্বিতীয় মাস্টার (চালক) হুমায়ুন কবিরের সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অপরদিকে রজনীগন্ধা ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news